কিরীটী পাইপটা ধরিয়ে একটা আরাম-কেদারার ওপর গা ঢেলে দিল—মনের মধ্য তখন তার একটি মুখ বার বার ভেসে ভেসে উঠছে।
সুধন্য!
কে ওই ছেলেটি? চিত্রাঙ্গদা দেবীর কাছ থেকে বোঝা গেল প্রায়ই এসে কিছু কিছু টাক নিয়ে যায়, চিত্রাঙ্গদা দেবীও ওকে টাকা দেন।
মুখে দেবো না বললেও শেষ পর্যন্ত ওকে দেন।
চিত্রাঙ্গদা দেবীর মত লোকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে যাচ্ছে—কোন গুঢ় কারণ না থাকলে নিশ্চয়ই চিত্রাঙ্গদা দেবী ওকে আমন করে বার বার টাকা দিতেন না।
কোন দেন ওকে চিত্রাঙ্গদা দেবী টাকা?
ভয়ে যে টাকা দেন না, তা বোঝা যায়। ভয় পাবার স্ত্রীলোক চিত্রাঙ্গদা দেবী নন। তাঁকে ভয় দেখিয়ে অর্থাৎ ব্ল্যাকমেইল করে টাকা নিচ্ছে সুধন্য, মনে হয় না কিরীটীর।
কিন্তু তার কারণটা কি? কি কারণ থাকতে পারে?
আর একটা মুখও মধ্যে মধ্যে কিরীটীর মনের পাতায় আনাগোনা করছিল। চিত্রাঙ্গদা। দেবীর বসবার ঘরে দেওয়ালে টাঙানো ওঁর স্বামী জিতেন্দ্ৰ চৌধুরীর ফটোর মুখখানা।
জিতেন্দ্ৰ চৌধুরী জেনেশুনেই চিত্রাঙ্গদা দেবীকে একদিন বিবাহ করেছিলেন। এক বাঈজী কন্যার ঔরসজাত চিত্রাঙ্গদা দেবী-কথাটা হরপ্রসাদ গোপন করেননি জিতেন্দ্ৰ চৌধুরীর কাছে। লোকটাও একেবারে শান্তশিষ্ট গঙ্গাজলে ধোয়া তুলসী পাতাটি ছিলেন না। গানবাজনার শখের সঙ্গে নারীপ্রীতিও ছিল তাঁর—প্রীতি না বলে নারীর প্রতি দুর্বলতা বললেই বোধ হয় ভাল হয়। তার প্রমাণ এখনো ইন্দ্ৰালয়েই রয়েছে-ওই বিগত যৌবনা ভূপৎ সিংয়ের স্ত্রী সুরতিয়া-রাজপুতানী।
এখনো যার দেহের গড়ন আমন, সে যে যৌবনে সত্যিকারের আকর্ষণীয় ছিল বুঝতে কষ্ট হয় না। জিতেন্দ্ৰ চৌধুরীর ওর যৌবনের প্রতি আকর্ষণ হওয়াটা এমন কিছু বিচিত্র নয়।
কে জানে ওই সুরতিয়া শেষ পর্যন্ত জিতেন্দ্র ও চিত্রাঙ্গদা-স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদের কারণ কিনা!
হঠাৎ-হঠাৎই যেন একটা সম্ভাবনা কিরীটীর মনের পাতায় উঁকি দেয়। আশ্চর্য! হ্যাঁ— সত্যিই তো, আশ্চর্য রকমের একটা মিলও আছে দুটো মুখে। তবে—তবে কি ওইটাই কারণ?
গণেশ এসে ঘরে ঢুকল।
বাবুজা!
কে?
খাবার দেব কি?
খাবার? রাত কটা হল?
রাত সোয়া নটা।
তাহলে একটু পরে।
গণেশ কিন্তু তথাপি ঘর থেকে যায় না, দাঁড়িয়েই থাকে।
কিছু বলবে গণেশ?
আজ্ঞে—কোন ড্রিঙ্ক দেব কি?
ড্রিঙ্ক!
হ্যাঁ।
হুইস্কি আছে?
আছে।
দাও এক পেগ। সোডা দিয়ে দিও।
গণেশ চলে গেল।
পরের দিন কিরীটীর ঘুম ভাঙল সানাইয়ের শব্দে। ভৈরো রাগে সানাই বাজছে। মনে পড়ল।রাণীমার জন্মতিথি-উৎসব আজ থেকেই।
০৮. জন্মতিথি উৎসব
সত্যই চিত্রাঙ্গদা দেবীর জন্মতিথি উৎসব রাত পোহানোর সঙ্গে সঙ্গেই সানাইয়ের মাঙ্গলিক দিয়ে শুরু হয়ে গিয়েছিল।
বিখ্যাত সানাই বাজিয়ে রহিম এসেছিল।
ভোর হল, চিত্রাঙ্গদা দেবী তার ঘরে স্নান করে একটা দুধ-গরদের থান পরে এসে বসলেন—একে একে সকলে তাঁকে শুভকামনা জানিয়ে যায়।
সকলকেই হাসি মুখে চিত্রাঙ্গদা দেবী সম্ভাষণ জানান—এ যেন এক নতুন চিত্রাঙ্গদা। প্রশান্ত সৌম্য সুন্দর হাস্যময়ী —আভিজাত্য ও দম্ভের খোলসটা যেন আজ তিনি খুলে ফেলে দিয়েছেন।
সকাল থেকে সারাটা দিন দলে দলে কত যে লোক আসে চিত্রাঙ্গদাকে শুভকামনা জানাতে! কেউ কিছু ফুল, কেউ অন্য কোন উপটৌকন, কেউ কিছু মিষ্টি। চিত্রাঙ্গদাও উদ্যানে বড় বড় দুটো তাঁবুতে অতিথি অভ্যাগতদের জলযোগ আপ্যায়নের ব্যবস্থা করেছিলেন। দুদিন ধরে হালুইকরেরা সব মিষ্টান্ন তৈরি করেছে—ভারে ভারে সব মিষ্টান্ন।
তারপর ক্রমশঃ সন্ধ্যা নামল। লাল-নীল সবুজ হলুদ-হরেক রকম আলোয় সারা ইন্দ্ৰালয় যেন ইন্দ্রপুরীর মতই ঝলমল করে ওঠে।
প্রথম দিন যাত্রার ব্যবস্থা ছিল। সারটা রাত ধরে যাত্রাগান হল। দ্বিতীয় দিনও অতিথি-অভ্যাগতদের ভিড়। রাত্রে বসল। গানের আসর। অনেক সব বড় বড় ওস্তাদ গাইয়েরা এসেছে।
পর পর তিন রাত্ৰি এবার গানের জলসা চলবে।
প্রথম রাত্রে আধুনিক, দ্বিতীয় রাত্রে রাগসঙ্গীত ও রবীন্দ্রসঙ্গীত, তৃতীয় রাত্রে ওস্তাদদের আসর।
রাত আটটা থেকেই আসর বসেছিল। কিরীটিও উপস্থিত ছিল আসরে।
চিত্রাঙ্গদা দেবীকেও কিরীটি দেখেছে। আসরে বসে গান শুনতে। তারপর যে কখন একসময় আসর ছেড়ে উঠে গেছেন, টের পায়নি। কিরীটী—গানের সুরে বোধ হয় তন্ময় হয়ে গিয়েছিল।
রাত তখন বোধ হয় এগারোটা বেজে কয়েক মিনিট হবে
বড়ে গোলাম আলি মাত্র কিছুক্ষণ আগে আসরে নেমেছেন—গণেশ এসে কিরীটীর পাশে দাঁড়াল।
বাবুজী!
ফিস ফিস করে ডাকে গণেশ।
কে, গণেশ! কি খবর?
জয়ন্ত দাদাবাবু আপনাকে এখুনি একবার ডাকছেন!
জয়ন্তবাবু! কোথায় তিনি?
রাণীমার ঘরে।
কিরীটী নিঃশব্দে সঙ্গীতের জমাটি আসর ছেড়ে উঠে পড়ল। প্রায় শতাধিক শ্রোতাসবাই গানের সুরের মধ্যে ড়ুবে রয়েছে।
কিরীটীর পূর্বেই স্বাতী ও তার ছোটদা শচীন্দ্র ছাড়া মণীন্দ্র, জগদীন্দ্র ও ফণীন্দ্র আসরেই উপস্থিত আছে। তারাও তন্ময় হয়ে গান শুনছিল।
চিত্রাঙ্গদা দেবীও তাঁর আসনে বসেছিলেন, কিন্তু আসর ছেড়ে যাবার সময় তাঁকে দেখা গেল না। তাঁর আসনটি শূন্য। কখন যে এক সময় তিনি উঠে চলে গেছেন, সে জানতে পারেনি।
আগের দু-রাত্রিতেও চিত্রাঙ্গদা দেবী যাত্রাগান শেষ হবার আগেই মাঝামাঝি সময় উঠে চলে গিয়েছিলেন যাত্রাগানের আসর ছেড়ে।
আজও হয়তো গেছেন—
যেতে যেতে লক্ষ্য পড়ল, সুধন্যও একপাশে শ্রোতাদের মধ্যে বসে গান শুনছে।