না।
আশচর্য!
ব্যাপারটা শোনার পর আমরাও কম আশ্চর্য হইনি। যাই হোক, তারপর বড়মার বাবা রায় বাহাদুরের মৃত্যুর পর জেঠামশাই আরো বছর পাঁচেক বেঁচে ছিলেন। তিনি তঁর শিকার, মদ্যপান, গান-বাজনা ও মেয়েমানুষ নিয়েই থাকতেন-বিজনেস বা সংসারের কোন ব্যাপারে কোনদিন মাথা গলাননি। সব কিছু থেকে দূরে থেকেছেন। নীচের মহলেই জেঠামশাই থাকতেন শুনেছি-কদাচিৎ কখনা কলে-ভদ্রে হয়ত ওপরে আসতেন।
কিরীটীর কাছে যখন জয়ন্ত চৌধুরী অতীত ইতিহাস বলছিল, চিত্রাঙ্গদা দেবীর শয়নঘরে তখন অন্য এক পর্ব চলছিল।
চিত্রাঙ্গদা সুধন্যকে নিয়ে তাঁর শয়নঘরে এসে ঢুকলেন।
গতবার টাকা নেওয়ার সময় কি বলেছিলে তুমি? ঘরে ঢুকেই ঘুরে দাঁড়িয়ে চিত্রাঙ্গদা। সুধন্যকে প্রশ্ন করেন।
কি জানি, ঠিক মনে পড়ছে না কি বলেছিলাম! কি বলেছিলাম বলুন তো রাণীমা? সুধন্য স্মিতহাস্যে প্রশ্নটা করে চিত্রাঙ্গদার মুখের দিকে তাকাল।
ভুলে গেছে, না?
হ্যাঁ-মনে পড়ছে না। সত্যিই বিশ্বাস করুন—
বলেছিলে আর এক বছরের মধ্যে টাকা চাইতে আসবে না।
বলেছিলাম নাকি? তা যদি বলেও থাকি—এক বছর নিশ্চয়ই হয়ে গেছে।
তিন মাসও পার হয়নি।
সত্যি! আমি তো ভাবছিলাম এক বছরেরও বেশী হয়ে গেছে।
শোন, তোমার সঙ্গে আমার এবার একটা শেষ বোঝাপড়া দরকার
তার মানে?
মানে, আজ যা হবার হয়ে যাক শেষবারের মত। আর কখনো জীবনে এ বাড়িতে তুমি
পা দেবো না।
বাঃ, তা কি করে হবে! আমার চলবে কি করে? আমার তো আর আপনার মত কাঁড়িকাঁড়ি টাকা নেই।
কি করে তোমার চলবে না চলবে, সেটা আমার ভাববার কথা নয়—সেটা সম্পূর্ণ তোমার। তুমি কি করবে না করবে, কিভাবে তোমার চলবে, না চলবে সে তুমিই ভাববে।
আমিই ভাববো!
হ্যাঁ।
কিন্তু তা কি সম্ভব হবে?
আমি তোমার ঠাট্টার পাত্রী নই। সুধন্য।
ছিঃ, ছিঃ, তা কি আর আমি জানি না!
শোন, তোমাকে আজ আমি শেষবারের মত কিছু টাকা দেবো একটি শর্তে, ভবিষ্যতে কোন দিন আর একটি আধলাও তুমি আমার কাছে পাবে না-একটি কপৰ্দকও তোমাকে আর কখনো আমি দেব না। আর তুমি যদি ভবিষ্যতে কখনো এ বাড়ির ত্রিসীমানায় পা দাও তো সেই মুহুর্তে তোমাকে আমি গুলি করে মারব।
মারবেন!
হ্যাঁ, মেরে বাগানে পুঁতে রাখব মাটির নীচে।
সুধন্য যেন কি ভাবল কিছুক্ষণ, তারপর বললে, বেশ তাই হবে। কিন্তু কত দেবেন?
আপাতত এই মুহুর্তে তোমাকে পাঁচ হাজার টাকা দেবো।
পাঁচ হাজার!
হ্যাঁ আর যদি দেখি দু বছর এ বাড়ির ত্রিসীমানায় তুমি আসোনি তাহলে আরো পাঁচ হাজার টাকা তোমাকে আমি পাঠিয়ে দেবো।
বেশ, তাই হবে। তাহলে এখান থেকে যাবার দিনই টাকাটা নেবো।
এখুনি তোমাকে টাকা নিয়ে এখান থেকে চলে যেতে হবে।
০৭. এখুনি চলে যেতে হবে
এখুনি চলে যেতে হবে?
হ্যাঁ।
আপনার জন্মদিন-উৎসব কাল থেকে। কত লোকজন আসবে, কত খাওয়া-দাওয়া নাচগান হবে-আর এ সময় আমাকে আপনি তাড়িয়ে দেবেন রাণীমা?
সুধন্যর কথাটা হঠাৎ যেন চিত্রাঙ্গদার মনকে নাড়া দেয়। মনে হয়, সত্যিই তো, এই উৎসবের মুখে লোকটাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবেন! কিন্তু পরীক্ষণেই মনে হয়। আবার, ওর মত একটা জঘন্য প্রকৃতির লোক বুঝি তার সে অনুকম্পােরও যোগ্য নয়।
চুপ করে থাকেন চিত্রাঙ্গদা দেবী।
থাকি না দুটো দিন?
না।
কতদিন ভালমন্দ দুটো খাইনি রাণীমা—
আর আপত্তি করতে পারলেন না চিত্রাঙ্গদা দেবী। বললেন, ঠিক আছে, থাক। কিন্তু মাত্র দুদিন, তার বেশি নয়।
বেশ, তাই।
কিন্তু বাড়ির ভেতরে আসবে না, বাইরে বাগানে তাঁবুতে থাকবে।
তাই থাকব।
যাও, এখন তাহলে নীচে যাও।
সুধন্য ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
সুধন্য ঘর থেকে চলে যাবার পর চিত্রাঙ্গদা ঘরের দেওয়ালে টাঙানো তাঁর স্বামী জিতেন্দ্রর বিরাট অয়েল-পেন্টিংটার দিকে তাকান।
জিতেন্দ্ৰ যেন তাঁর দিকে তাকিয়ে মিটমিটি হাসছেন।
চিত্রাঙ্গদার চোখ দুটো যেন জ্বলতে থাকে।
উঃ, কি লজ্জা, কি লজ্জা! তাঁর জন্মমুহূর্ত থেকে যে লজ্জা তাঁর সমস্ত জীবনের সঙ্গে একেবারে ওতপ্রোত হয়ে গেছে, তার হাত থেকে বুঝি সত্যিই কোন দিনই আর মুক্তি নেই।
এতকাল বয়ে এসেছেন সে লজ্জা, এবং যতদিন বাঁচবেন তাঁকে টেনে যেতে হবে।
কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, জিতেন্দ্রর দোষ কি? তার জন্মের জন্য তো জিতেন্দ্ৰ দায়ী নন?
দায়ী যদি কেউ হন তা তার জন্মদাতা। —তাঁর বাবা হরপ্রসাদ। যার জঘন্য লালসা এক।
হঠাৎ মনে পড়ে, পাশের ঘরে কিরীটী আর জয়ন্ত এখনো তার জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু এই মুহুর্তে আর তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে ইচ্ছা করছে না চিত্রাঙ্গদা দেবীর।
চিত্রাঙ্গদা ডাকে, সুরতিয়া!
সুরতিয়া ঘরে এসে ঢুকল, ডাকছিলে রাণীমা?
হ্যাঁ শোন, ওঘরে গিয়ে জয়ন্তকে বলে দে, শরীরটা ভাল লাগছে না। আমার, আজ আর ও ঘরে যাব না।
সুরতিয়া মাথা হেলিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
পাশের ঘরে গিয়ে যখন ঢুকল, জয়ন্ত আর কিরীটী তখনো গল্প করছে।
রাণীমা বললেন, তার শরীরটা ভাল লাগছে না, এখন আর আসবেন না।
জয়ন্ত আর কিরীটী পরস্পর পরস্পরের মুখের দিকে তাকাল নিঃশব্দে।
সুরতিয়া সংবাদটা দিয়ে আর অপেক্ষা করে না, ঘর থেকে বের হয়ে যায়।
কিরীটী জয়ন্তর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, তাহলে চলুন মিস্টার চৌধুরী, ওঠা যাক।
হ্যাঁ, চলুন।
জয়ন্ত উঠে দাঁড়াল।
পূর্বের সেই সিঁড়িপথেই পুনরায় দুজনে নীচে নেমে এল। এবং কিরীটীকে ঘরে পৌঁছে দিয়ে জয়ন্ত চলে গেল।