কিরীটী বুঝতে পারে, চিত্রাঙ্গদা দেবী যেন বেশ একটু বিচলিত। বিব্রত।
মিস্টার চৌধুরী!
এই লোকটি কে?
চিনতে পারলাম না ঠিক। জয়ন্ত চৌধুরী মৃদু কণ্ঠে জবাব দিল।
আগে কখনো ওকে এখানে দেখেননি? কিরীটী পুনরায় প্রশ্ন করে।
না, এই প্রথম দেখলাম।
কিন্তু মনে হল লোকটার এ বাড়িতে আসা-যাওয়া আছে!
আমারও সেই রকম মনে হচ্ছে, তবে আমি তো এখানে থাকি না।
এবং আপনার বড়মার বিশেষ পরিচিতও মন হল। কিরীটী আবার বলে।
বিশেষ পরিচিত। বিস্মিত হয়েই তাকাল জয়ন্ত চৌধুরী কিরীটীর মুখের দিকে।
হ্যাঁ, দেখলেন না–কেমন করে এ ঘরের মধ্যে এসে সোজা ঢুকে পড়ল, ঢুকে টাকা চাইল। ওর এ ঘরে ঢোকা ও চাওয়ার ধরনটা দেখে মনে হল মধ্যে মধ্যে এসে ও ওইভাবে আপনার বড়মার কাছ থেকে টাকা নিয়ে যায়—আর আপনার বড়মার কথা শুনেও তো মনে হল।
সেই রকমই তো মনে হল! জয়ন্ত চৌধুরী মৃদু কণ্ঠে বলে।
মনে হল না মিস্টার চৌধুরী, তাই-কিন্তু কেন? আপনার বড়মা ওকে মধ্যে মধ্যে টাকা দিন কেন?
শেষের কথাগুলো যেন কতকটা স্বগতোক্তির মতই মনে হল জয়ন্তর।
কি বললেন? জয়ন্ত চৌধুরী প্রশ্ন করে।
না, কিছু না। কিন্তু লোকটা কে হতে পারে? আপনাদের পরিচিত বা আপনজন কেউ নয়; তাহলে তো আপনারা চিনতেনই। অথচ একেবারে নিঃসম্পর্কীয় বাইরের কেউ হলেই বা ওইভাবে অন্দরে এই রাত্রে সোজা একেবারে রাণীমার খাসমহলে এসে প্রবেশ করেই বা কি করে, আর আমন করে নিঃসঙ্কোচে টাকার দাবিই বা করে কি করে?
দাবি!
নয় কি-ওর টাকা চাওয়ার ধরনটা দেখলেন না! শুধু দাবিই নয়, ও যে মধ্যে মধ্যে টাকা পেয়েও থাকে, তা তো শুনলেন। আপনার বড়মার মুখেই। হ্যাঁ, তাই তো শুনলাম।
এই সময় সুরতিয়া এসে আবার ঘরে ঢুকল। হাতে তার ট্রেতে চায়ের সরঞ্জাম। ট্রেটা সামনের একটা গোল টেবিলের ওপরে নামিয়ে রেখে সে জিজ্ঞাসা করল, চা তৈরী করে দেব বাবুজী?
কিরীটী সঙ্গে সঙ্গে বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, দাও।
সুরতিয়া চা তৈরী করতে থাকে। ঝুকে পড়ে নীচু হয়ে সুরতিয়া কাপে চা ঢালতে ঢালতে জিজ্ঞাসা করে, কত চিনি দেব বাবুজী?
দু’ চামচ। কিরীটী বলে।
সুরতিয়া জানে জয়ন্ত চায়ে কতটুকু চিনি খায়, তাই হয়ত ও সম্পর্কে কোন প্রশ্ন বা জিজ্ঞাসাবাদ করল না।
সুরতিয়া চা তৈরী করছে নীচু হয়ে ঝুঁকে। মুখটা তার ভাল করে স্পষ্ট দেখা ধাচ্ছে না। কিন্তু তার হাত নাড়া দেখে কিরীটীর মনে হয় সুরতিয়া যেন একটু চিন্তিত—একটু বিচলিত।
চা সে তৈরি করছে বটে ওদের জন্য, কিন্তু মনটা তার বোধ হয়। চা তৈরি করার মধ্যে নেই। অন্য কোথাও বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে।
কিরীটী তীক্ষ দৃষ্টিতে লক্ষ্য করছিল সুরতিয়াকে।
চা তৈরি করে দিয়ে সুরতিয়া আর দাঁড়াল না। ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
কিরীটীর চোখের তীক্ষ দৃষ্টি সুরতিয়াকে ঘর ছেড়ে চলে যাওয়া পর্যন্ত লক্ষ্য করে। কিরীটীর মনে হল যেন একটু দ্রুত এবং চঞ্চল পায়েই ঘর ছেড়ে গেল সে।
কিরীটী এবার জয়ন্ত চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে আবার ডাকল, মিস্টার চৌধুরী!
কিছু বলছিলেন?
হ্যাঁ। এই দাসীটি অনেকদিন ইন্দ্ৰালয়ে আছে, না? মানে ঐ সুরতিয়া—
হ্যাঁ, অনেক দিনকার দাসী।
আপনার স্বৰ্গীয় জেঠামশাইয়ের আমলের বোধ হয়?
মৃদু কণ্ঠে এবার জবাব দেয় জয়ন্ত, হ্যাঁ, ওর যখন ভরা যৌবন, তখন ও এখানে আসে।
এখন বয়স কত হবে ওরা?
তা ধরুন চল্লিশ-পয়তাল্লিশ তো হবেই।
সেই রকম আমারও মনে হল।
একটা কথা বোধ হয় আপনাকে আমার বলা উচিত—একটু ইতস্তত করে যেন জয়ন্ত চৌধুরী।
কি বলুন তো? আপনাকে তো একটু আগেই বলছিলাম, শ্বশুরের মত জামাইয়ের—অর্থাৎ আমার জেঠামশাইয়ের স্ত্রীলোকের ব্যাপারে একটু দুর্নাম ছিল—
কিরীটী ওর মুখের দিকে তাকাল।
জয়ন্ত চৌধুরী বলে, ওই সুরতিয়া কিন্তু এ দেশের মেয়ে নয়, একদিন এসেছিল ওর স্বামীর সঙ্গে রাজপুতানা থেকে।
রাজপুতানা!
হ্যাঁ, জিতেন্দ্ৰ চৌধুরীর ঘোড়ার শখ ছিল। সেই ঘোড়ার দেখাশোনা করবার জন্য জশলমীর থেকে ভূপৎ সিং আসে, সঙ্গে আসে তার তরুণী বউ সুরতিয়া। তখন সে উদ্ভিন্নযৌবনা। সুরতিয়া এখানে আসার সঙ্গে সঙ্গে বলা বাহুল্য জিতেন্দ্ৰ চৌধুরীর নজরে পড়ে গেলি-সঙ্গে সঙ্গে অন্দরের কাজে বহাল হল সে।
তারপর?
ভূপৎ সিং কৃতাৰ্থ হয়ে গেল। বেচারা জানত না তো যে জিতেন্দ্ৰ চৌধুরীর ওই বানান্যতার অন্তরালে কি উদ্দেশ্য লুকিয়ে আছে! যা হোক, সুরতিয়া অন্দরে এসে ঢুকল একেবারে চিত্রাঙ্গদা দেবীর খাস চাকরাণী হয়ে—
বলেন কি!
হ্যাঁ কিন্তু তার আগে থেকেই জিতেন্দ্ৰ চৌধুরী পৃথক ঘরে শয়ন করতেন।
কেন, চিত্রাঙ্গদা দেবীর সঙ্গে কি তার সদ্ভাব ছিল না?
না, এবং সেটা বিবাহের কিছুদিন পর থেকেই।
চিত্রাঙ্গদা দেবীর বাবা জানতেন না সে-কথা?
মৃত্যুর বৎসর দুই পূর্বে জানতে পেরেছিলেন এবং মেয়ে-জামাইয়ের মনো-মালিন্যটা মিটিয়ে দেবার চেষ্টাও করেছিলেন, কিন্তু সফল হননি। আর তার কারণও বড়মা—
কি রকম?
সে তো আপনাকে আগেই বলেছি—আমার ধারণা, তার মানে বড়মার চিরদিনের ঐ উদ্ধত দাম্ভিক প্রকৃতি ও অন্যকে সর্বক্ষণ দাবিয়ে রাখবার সেই বিচিত্র complex-এর জন্যই—
মনোমালিন্যের কারণটা কি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে, সেটাই আপনি মনে করন?
তাছাড়া আর কি হতে পারে?
হুঁ, তারপর?
তারপর বড়মার বাবা তার সমস্ত সম্পত্তি স্থাবর-অস্থাবর একমাত্র মেয়ের নামে লিখে দেন।
আপনার জেঠামশাই তাতে কিছু বলেননি?