- বইয়ের নামঃ সর্পিল
- লেখকের নামঃ নীহাররঞ্জন গুপ্ত
- বিভাগসমূহঃ গোয়েন্দা কাহিনী
০১. জয়ন্ত চৌধুরী যখন প্রথম চিঠিটা
জয়ন্ত চৌধুরী যখন প্রথম চিঠিটা কিরীটীর হাতে তুলে দিয়েছিল কিরীটী চিঠিটা একবার পড়েছিল—যেমন কোন মানুষ কোন চিঠি পড়ে ঠিক তেমনি করেই এবং সত্যিই তার মনে কোন কৌতূহলের উদ্রেক করেনি।
সে চিঠিটা ভাঁজ করে যে বইটা তখন সে বসে বসে পড়ছিল সেই বইটার মধ্যে ভাজ করে রেখে দিতে দিতে বলেছিল, কাল-পরশু একসময় একবার আসবেন তখন কথা হবে।
জয়ন্ত চৌধুরী কিরীটীকে কিছুটা চিনত তাই দ্বিতীয় আর কোন অনুরোধ করেনি—সেদিনকার মত বিদায় নিয়েছিল।
হাতের লেখাটা সামান্য একটু কাঁপা কাঁপা হলেও স্পষ্ট, পড়তে কষ্ট হয় না আদৌ। লেখিকার হাতের লেখা যে কোন একসময় মুক্তোর মত পরিষ্কার ও ঝরঝরে ছিল, আজও সেটা বুঝতে কষ্ট হয় না যেন। পাতলা নীল রঙের চিঠির কাগজে লেখা চিঠিটা। চিঠির কাগজটা দামী এবং বিলিতি। চিঠির কাগজের ডানদিকে ওপরে মনোগ্রাম করে লেখা ইন্দ্ৰালয়।
খুব দীর্ঘ নয়—এক পৃষ্ঠার একটা চিঠি।
লেখিকা মনে হয় কিরীটীর চিঠিটা লিখতে লিখতে কখনো যেন থেমে গিয়েছে, কখনো আবার দ্রুতই কয়েকটা লাইন লিখে গিয়েছে। অক্ষরগুলোও সব সমান নয়, লাইনগুলোও মধ্যে মধ্যে বেঁকে গিয়েছে। ঠিক যেন সোজা হয়নি।
স্পষ্টই বোঝা যায়, একটা মানসিক উদ্বেগের মধ্যে যেন লেখিকা চিঠিটা কোনমতে লিখে শেষ করেছে। এবং সে-উদ্বেগটা লেখিকাকে বেশ একটু যেন বিচলিত করেছে। বিশেষ করে চিঠির মাঝামাঝি জায়গায় যেখানে সেই মানসিক উদ্বেগটা যেন বেশ স্পষ্টই হয়ে উঠেছে।
যত দিন যাচ্ছে ব্যাপারটা যেন বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ওদের প্রত্যেকের মনের মধ্যেই আমাকে হত্যা করবার একটা স্পাহা—সম্পূহা না বলে বোধ হয়। ইচ্ছাই বলা উচিত—অ! গু স্পষ্ট হয়ে উঠছে ক্রমশ। এবং তাতেই আমার মন হচ্ছে ওরা যেন প্রত্যেকে আমাকে হত্যা করবার জন্য ওৎ পেতে সুযোগের অপেক্ষা করছে। সেই জন্যই আমি স্থির করেছি, ওদের সে সুযোগটা দেবো। এভাবে মনের সঙ্গে অহৰ্নিশি যুদ্ধ করতে সত্যিই আর আমি পারছি না জয়ন্ত। মনে হচ্ছে যা হবার তা হয়ে যাক। আমি ভাল করে খেতে পারি না, ঘুমোতে পারি না—এভাবে এ বয়সে আমার নাভের সঙ্গে এই যুদ্ধ করার চাইতে মনে হচ্ছে যা ওরা চাইছে, আমি বোধ হয়। সেই অবশ্যম্ভাবীকে এমনি করে বেশিদিন ঠেকিয়ে রাখতে পারব না। তাই আমি মনে মনে স্থির করেছি। ওরা যদি হত্যা করে আমায় শান্তি পায় তো করুক ওরা আমাকে হত্যা। সত্যি এইভাবে সর্বক্ষণ বসে বসে মৃত্যুর প্রতীক্ষা করতে আর আমি পারছি না। ওদূের কারো হাতেই যদি আমার মৃত্যু আমার ভাগো লেখা থাকে তো তাই হোক।
আমিও নিষ্কৃতি পাই, ওদের ইচ্ছাটা পূর্ণ হয়।
পরের দিনই জয়ন্ত এসে আবার উপস্থিত হল।
কিরীটী আরাম-কেন্দারাটার ওপর গা এলিয়ে দিয়ে চিঠিটার কথা ভাবছিল।
বসুন জয়ন্তবাবু—
কি ঠিক করলেন? জয়ন্ত প্রশ্ন করে।
কিরীটী সামনে উপবিষ্ট জয়ন্ত চৌধুরীর দিকে তাকাল।
ভদ্রলোকের বয়স বেশি হবে না-ত্রিশের নীচে নয়, পয়ত্ৰিশের উদ্ধের্ব নয়। সাধারণ দোহারা চেহারা। গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যাম। চোখে-মুখে অদ্ভুত একটা বুদ্ধির দীপ্তি। পরনে গরম সম্মুট-স্যাটটা দামী, দেখলেই বোঝা যায়।
ভদ্রলোক মাকুন্দ-দাড়ি-গোঁফের চিহ্নমাত্রও চোখে পড়ে না। ভদ্রলোকের ডান চোখটা সামান্য টেরা—ভাল করে লক্ষ্য করে না দেখলে চট করে সেটা বুঝবার উপায় নেই অবিশ্যি।
এ চিঠিটা আপনি কবে পেয়েছেন মিস্টার চৌধুরী? কিরীটী প্রশ্ন করে।
দিন তিনেক হল।
চিঠির লেখিকা ভদ্রমহিলা, মানে চিত্রাঙ্গদা দেবী আপনার কে হন যেন বলছিলেন?
জেঠিমা।
বয়স কত হয়েছে তার?
আটষট্টি-ঊনসত্তর হবে। কিন্তু অত বয়স হলে কি হবে, দেহের বাঁধুনি এখনো এমন আটসঁটি যে, দেখলে মনে হয়। পঞ্চাশের বেশি নয়। তাছাড়া এখনো রীতিমত কর্মঠ। দুদুটো কলিয়ারী, ব্যাপার-অত বড় বিরাট দুটো অফিস, একটা ধানবাদে একটা কলকাতায়— সবকিছু তাঁর নখদর্পণে। কোথায় কি হচ্ছে না হচ্ছে, কোথায় কি হবে না হবে—সব কিছুর তিনি খবর রাখেন ও যাবতীয় প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেন।
হুঁ। আচ্ছা, ওই যে চিঠির মধ্যে উনি লিখেছেন—জগদীন্দ্ৰ, মণীন্দ্ৰ, ফণীন্দ্র, শচীন্দ্ৰ, স্বাতী প্রভৃতির কথা, ওরা কারা? ওদের সঙ্গে চিত্রাঙ্গদা দেবীর কি সম্পর্ক?
ওরা সব আমার মেজ জেঠামশায় হীরেন্দ্ৰ চৌধুরীর ছেলেমেয়ে।
তার মানে, ওঁর দেওরের ছেলেমেয়ে? কিরীটী শুধাল।
হ্যাঁ। আমাদের ফ্যামিলি হিস্ট্রিটা আপনার বোধ হয় একটু জানা দরকার মিস্টার রায়। জয়ন্ত চৌধুরী বলে।
সংক্ষেপে বলুন।
হ্যাঁ, সেটা আপনার বোধ হয় জানা দরকার।
অতঃপর জয়ন্ত চৌধুরী বলতে শুরু করে।
পৌষের শেষ। শহরে শীতটা যেন বেশ দাঁত বসিয়েছে। তার ওপরে দিন দুই হল আকাশটা মেঘলা-মেঘলা, এবং টিপটপ করে মধ্যে মধ্যে বৃষ্টিও পড়ছে। আর থেকে থেকে এলোমেলো হাওয়া দিচ্ছে।
জয়ন্ত চৌধুরী বলতে লাগল—কিরীটী চুরুটটায় আবার অগ্নিসংযোগ করে নিল। জেঠামশাইরা তিন ভাই ছিলেন, জিতেন্দ্ৰ, হীরেন্দ্র ও নীরেন্দ্ৰ চৌধুরী। ঠাকুরদা তাঁর ছেলেদের সাধ্যমত লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করবার চেষ্টা করেছিলেন।
জয়ন্ত চৌধুরী বলতে লাগল একটু থৈমে, চিরদিনের জেদী ও ডানপিটে স্বভাব ছিল বড় ছেলে জিতেন্দ্ৰ চৌধুরীর। পড়াশুনায় আন্দীে মন ছিল না, দিবারাত্র গান-বাজনা নিয়েই থাকত।