মোটিভের কথাই যদি বলেন তো সে কখন কি রূপে প্রকাশ পায় বা মূলে কি থাকতে পারে, বিশেষ করে নারীমনের—সে-কথা চিন্তা করতে গেলে খেই পাবেন না! যাক সে কথা, সরল ও দ্বিধাহীন মন নিয়ে ভাববার চেষ্টা করুন—বলতে বলতে হঠাৎ কিরীটীর কণ্ঠস্বরে লঘু রহস্যপ্রিয়তার একটা সুর যেন ধ্বনিত হয়ে ওঠে। সে আমার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে শিবেন সোমকে সম্বোধন করে বলে, আরে বেশী দূরে যেতে হবে কেন, আপনি ঐ সুব্রতকেই জিজ্ঞাসা করে দেখুন না—এত বয়স হল তবু আজও যে ও কুমার কার্তিকটিই রয়ে গেল, সেও ঐ নারীমনের কোন হদিস পেল না বলেই না!
সে কি, সুব্রতবাবু—
শিবেন সোমের প্রশ্নসূচক কথাটা শেষ করল কিরীটীই। বললে, না, বেচারী আজও ওপথে পা মাড়ায় নি। কিন্তু এবারে সত্যিই গাত্রোখান করতে হবে, তালাটা যখন ভাঙা তখন। একটিবার সেখানে আমাদের যাওয়া প্রয়োজন—বলতে বলতে কিরীটী উঠে দাঁড়াল, একটু অপেক্ষা করুন আমি আসছি—
.
বিমলবাবুর গৃহে যখন আমরা এসে পৌঁছলাম আসন্ন সন্ধ্যার ধূসর ছায়ায় চারদিক তখন ম্লান হয়ে এসেছে। বাড়ির দোতলায় ইতিমধ্যেই আলো জ্বলে উঠেছে, নীচের তলাটা অন্ধকার।
বারান্দার কাছাকাছি আসতেই বারান্দার ডান দিক থেকে পুরুষকণ্ঠে প্রশ্ন ভেসে এল, কে?
জবাব দিলেন শিবেন সোম, আমি শিবেন সোম।
প্রশ্ন করার সঙ্গে সঙ্গেই ভদ্রলোক এগিয়ে এসেছিলেন। আবছা আলোছায়ায় সামনের দিকে তাকিয়ে ভদ্রলোককে চিনতে কষ্ট হল না, মৃত বিমলবাবুর ছোটবেলার বন্ধু বিনায়ক সেন।
বিনায়ক সেন বারেকের জন্য আমাদের সকলের মুখের উপরে একবার দৃষ্টিটা বুলিয়ে নিয়ে বললেন, ও আপনারা!
বিনায়ক সেনের গলার স্বর শুনে সেই দিকে তাকাতেই আবছা আলোছায়ার মধ্যেও একটা ব্যাপার লক্ষ্য করছিলাম, বিনায়ক সেনের পাশ থেকে আবছা একটা ছায়ামূর্তি যেন আমাদের সাড়া পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওদিককার অন্ধকারে দ্রুত মিশিয়ে গেল। এবং ব্যাপারটা যে কিরীটীরও নজরে এসেছিল বুঝতে পারলাম তার পরবর্তী প্রশ্নেই।
অন্ধকারে আপনার পাশে ওখানে আর কে ছিল মিঃ সেন?
কিরীটীর আচমকা প্রশ্নে যেন বিনায়ক সেন হঠাৎ কেমন থতমত খেয়ে যান, বলেন, আ-আমার পাশে? কই না–কেউ তো নয়!
কিন্তু মনে হল যেন—
কই না—আমি তো একাই ছিলাম!
কিন্তু অন্ধকারে একা একা ওখানে দাঁড়িয়ে কি করছিলেন?
না, মানে—এত বড় একটা মিসহ্যাপ হয়ে গেল তাই একবার খোঁজখবর নিতে। এসেছিলাম। তারপরই একটু থেমে আবার বললেন বিনায়ক সেন, বুঝতেই তো পারছেন মিঃ। রায়, বিমলের মৃত্যুটা স্বাভাবিক নয়, কেউ তাকে হত্যা করেছে ব্যাপারটা জানার পর থেকেই সকলেই এরা কেমন যেন আপসেট হয়ে পড়েছে
তা তো হবারই কথা!
হ্যাঁ, দেখুন তো কোথাও কিছু নেই হঠাৎ কোথা থেকে কি একটা দুম করে বিশ্রী ব্যাপার ঘটে গেল!
তা তো বটেই!
বলুন তো, আমি তো মশাই সত্যি কথা বলতে কি, মাথামুণ্ডু ব্যাপারটার কিছুই এখনো বুঝতে পারছি না! হঠাৎ তাকে ঐভাবে কেউ হত্যাই বা করতে গেল কেন?
ব্যাপারটা হঠাৎ নয় বিনায়কবাবু, শান্ত দৃঢ় কণ্ঠে কিরীটী কথাটা বললে।
হঠাৎ নয়?
না, আদৌ নয়। সব কিছুই পূর্বপ্রস্তুতি এবং পূর্ব-প্ল্যান বা পরিকল্পনা মত ঘটেছে।
মানে?
মানে কালই ঠিক না হলেও আজ-কাল-পরশু খুব শীঘ্রই যে কোন একদিন তিনি নিহত। হতেনই!
না না—এ আপনি কি বলছেন মিঃ রায়?
কথাটা আমি একবিন্দুও মিথ্যা বলছি না বা অত্যুক্তি করছি না মিঃ সেন। সত্যিই মৃত্যু তার পাশে এসে একেবারে দাঁড়িয়েছিল—মৃত্যুর কালো ছায়া তাকে গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছিল। যাক সেকথা, চলুন ওপরে যাওয়া যাক।
না না–এখন আর ওপরে যাব না আমি। আমার একটু কাজ আছে, আমি যাই—
দেখা করবেন না ওঁদের সঙ্গে?
না, থাক। অন্য সময় আসবখন। আচ্ছা চলি মিঃ রায়, নমস্কার।
কথাটা বলে আর মুহূর্তমাত্র দাঁড়ালেন না বিনায়ক সেন, বারান্দা থেকে নেমে দ্রুত সন্ধ্যার ঘনায়মান অন্ধকারে গেটের দিকে এগিয়ে গেলেন।
.
হঠাৎ যেন মনে হল সকলে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। কারো মুখে কোন কথা নেই।
স্তব্ধতা ভঙ্গ করল কিরীটীই, শিবেনবাবু, মৃতদেহ প্রথম ডিসকভার্ড হয় কাল রাত্রে ঠিক। কটার সময় যেন?
।রাত আটটা পঁয়তাল্লিশ, মানে—
পৌনে নটা নাগাদ, না? এবং সোয়া সাতটা নাগাদ রঞ্জনবাবু এসে জানান ফোনে কেউ তাকে ডাকছে–
হ্যাঁ।
কাল দেখেছিলাম, মনে আছে মৃতদেহ পরীক্ষার সময়, তখনো রাইগার মর্টিস সেট ইন করে নি। তা হলে মনে হচ্ছে সম্ভবতঃ সোয়া সাতটা থেকে পৌনে নটার মধ্যে—অর্থাৎ মাঝখানের ঐ দেড় ঘণ্টা সময়ের মধ্যেই কোন এক সময় হত্যা করা হয়েছে। দেড় ঘণ্টা সময়—নট এ জোক! শেষের দিকে কথাগুলো কিরীটী যেন কতকটা আত্মগতভাবেই অত্যন্ত মৃদুকণ্ঠে বললে।
ফলে শেষের কথাগুলো বোধ করি শিবেনবাবুর কর্ণগোচর হয় নি। তাই তিনি বলেন, কি বললেন মিঃ রায়?
মৃদুকণ্ঠে কিরীটী আবার বলে, র্যাদার কুঈয়ার—বেশ একটু আশ্চর্যই—
আশ্চর্য! কি আশ্চর্য মিঃ রায়?
কিছু না। চলুন ওপরে যাওয়া যাক। কিন্তু নীচের তলাটা একেবারে খালি, একজন চাকরবাকরকেও তো দেখছি না ব্যাপার কি? এ বাড়িতে চাকরবাকর কেউ নেই নাকি?
.
১৩.
কিরীটীর কথাটা শেষ হল না, দপ্ করে ঐ সময় সিঁড়ির আলোটা জ্বলে উঠল। দেখা গেল একজন প্রৌঢ় এবং বেশভূষায় ও চেহারায় ভৃত্য শ্রেণীরই কোন লোক হবে, সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে।