শিবেন সোমই কয়েকটা মামুলী প্রশ্ন করবার পর কিরীটী মাঝখানে বাধা দিল।
মিঃ সরকার, এ কথা কি সত্যি যে অদূর ভবিষ্যতে একদিন বিমলবাবুর একমাত্র ভাইঝি শকুন্তলা দেবীর সঙ্গে আপনার বিবাহ দেবেন বলে তিনি আপনাকে কথা দিয়েছিলেন?
কথার মাঝখানে কিরীটীর কথাটা এমন অতর্কিতে উচ্চারিত হয়েছিল যে রাঘব সরকার যেন হঠাৎ চমকে উঠে কিরীটীর মুখের দিকে না তাকিয়ে পারলেন না।
কিরীটী আবার প্রশ্ন করল, কথাটা কি সত্যি?
হ্যাঁ।
কথাটা তাহলে সত্যি?
হ্যাঁ। কিন্তু হঠাৎ এ কথাটা আপনি জানলেনই বা কি করে আর জিজ্ঞাসাই বা করছেন। কেন?
জানলাম কি করে নাই বা শুনলেন, আর জিজ্ঞাসা করছি কেন যদি প্রশ্ন করেন তো বলব, ব্যাপারটা কেমন যেন একটু অস্বাভাবিক তাই জানতে চাইছিলাম—
অস্বাভাবিক কেন?
দেখুন মিঃ সরকার, আজকের দিনে অসবর্ণ বিবাহের কথাটা আমি তুলব না, কিন্তু আপনি নিশ্চয়ই জানেন শকুন্তলা দেবী মনে মনে বিমলবাবুর ছাত্র দুষ্মন্ত রায়কে ভালবাসেন!
না, জানি না।
জানেন না?
না।
কিন্তু–
আর যদি বাসেই, তাতে আমার কি?
কিন্তু একজন নারী মনে মনে অন্য এক পুরুষকে কামনা করে জেনেও সেই নারীকে আপনি বিবাহ করতে চলেছেন!
দেখুন আপনারা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে এনক্রোচ করবেন না।
অবশ্যই করতাম না, যদি আজকের এই দুর্ঘটনাটা না ঘটতে!
মানে কি বলতে চান আপনি?
বলতে যা চাই সেটা কি খুব অস্পষ্ট মনে হচ্ছে আপনার মিঃ সরকার?
অবশ্যই! কারণ সে কথা আসছেই বা কি করে?
আচ্ছা ছেড়ে দিন সে কথা, অন্য একটা কথার জবাব দিন!
বলুন?
অধ্যাপকের সঙ্গে আপনার কি সূত্রে আলাপ হয় প্রথমে?
প্রথমে আলাপ হয়েছিল আমার দোকানের একজন কাস্টোমার হিসাবে।
তারপর?
তারপর আবার কি! সেই আলাপই ক্রমে ঘনিষ্ঠতায় পরিণত হয়।
এমন ঘনিষ্ঠতায় পরিণত হল যে একেবারে বিবাহ-সম্পর্ক! একটু বেশী হল না কি মিঃ সরকার?
কথাটা কিরীটী বেশ শান্ত ও নির্বিকার কণ্ঠে বললেও, মনে হল যেন ব্যঙ্গের একটু সুর লেগে আছে তার বলার ভঙ্গীতে, তার কণ্ঠের স্বরে।
এই সব অবান্তর প্রশ্ন আপনারা কেন করছেন আমি বুঝতে পারছি না! রাঘব সরকার বিশেষ বিরক্তিপূর্ণ কণ্ঠেই যেন কথাটা বলে উঠলেন।
আচ্ছা রাঘববাবু, আপনি নিশ্চয়ই জানতেন আপনার ক্লায়েন্ট ও ভাবী শ্বশুরমশাই রক্তচাপাধিক্যে ভুগছেন! কিরীটী আবার কথা বললে।
না। তীক্ষ্ণ প্রতিবাদ।
জানতেন না?
না।
আশ্চর্য! অমন একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আপনাদের মধ্যে হতে চলেছিল, অথচ ঐ কথাটাই আপনি জানতেন না?
বিরক্তি ও ক্রোধপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন রাঘব সরকার কিরীটীর মুখের দিকে এবং তীক্ষ্ণকণ্ঠে বললেন, মশাই আপনি কে জানতে পারি কি?
উনি পুলিসেরই লোক মিঃ সরকার। জবাব দিলেন শিবেন সোম, উনি যা জিজ্ঞাসা করছেন তার জবাব দিন।
মিঃ সরকার! আবার কিরীটী ডাকল।
মুখে কোন জবাব না দিয়ে পূর্ববৎ বিরক্তিপূর্ণ সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে পুনরায় তাকালেন রাঘব সরকার কিরীটীর মুখের দিকে।
আপনার কি এটাই প্রথম সংসার করবার অভিলাষ নাকি?
মানে?
মানে জিজ্ঞাসা করছিলাম, ইতিপূর্বে কি আপনি বিবাহাদি করেন নি?
করেছি।
কি বললেন আপনি? বিবাহ—
হ্যাঁ করেছিলাম—সে স্ত্রী আজ পাঁচ বছর হল গত হয়েছেন।
ছেলেপুলে?
না, নেই।
তাহলে পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা বলুন!
কটমট করে আবার রাঘব সরকার তাকালেন কিরীটীর মুখের দিকে এবং রূঢ়কণ্ঠে বললেন, আপনি বিমলবাবুর মৃত্যুব তদন্ত করছেন, না আমার ঠিকুজিনক্ষত্র সম্পর্কে খোঁজ নিচ্ছেন—কোন্টা করছেন বলতে পারেন?
এক ঢিলে দুই পাখিই মারছি! তবে আপনি একটু ভুল করছেন মিঃ সরকার, বিমলবাবুর মৃত্যুর নয়—হত্যার তদন্ত করছি আমরা!
কি বললেন?
বললাম তো হত্যা!
ও, আপনাদের ধারণা বুঝি বিমলবাবুকে হত্যা করা হয়েছে?
ধারণা নয়, সেটাই সত্য। যাক সে কথা—আচ্ছা আপনি বলেছেন অবিশ্যি একজন খরিদ্দার হিসাবেই বিমলবাবুর সঙ্গে আপনার প্রথম পরিচয় ও পরে ঘনিষ্ঠতা, কিন্তু আমি যেন শুনেছিলাম আপনার সঙ্গে বিমলবাবুর ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল রেসের ময়দানে—কথাটা কি সত্যি?
কি বললেন?
জিজ্ঞাসা করছি রেসের ময়দানেই কি আপনাদের উভয়ের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল?
হঠাৎ যেন মনে হল রাঘব সরকারের সমস্ত আক্রোশ ও বিরক্তি দপ করে নিভে গিয়েছে। মুখখানা তার যেন একেবারে হঠাৎ চুপসে গিয়েছে।
কি, জবাব দিচ্ছেন না যে?
কিসের জবাব চান?
যে প্রশ্নটা করলাম!
জবাব দেবার কিছু নেই।
কেন?
কারণ কিছু নেই বলে!
I see! আচ্ছা মিঃ সরকার, আপনি যেতে পারেন।
রাঘব সরকার মাথা নিচু করে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। এবং রাঘব সরকার ঘর থেকে বের হয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই শিবেন সোম কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, ব্যাপারটা ঠিক কি হল মিঃ রায়?
কিসের ব্যাপার?
লোকটা যে রেস খেলে, জানলেন কি করে?
সামান্য একটা সূত্রের উপর নির্ভর করে—স্রেফ অনুমানের ওপরেই ঢিল ছুঁড়েছিলাম। সামান্য সূত্র!
হ্যাঁ, গতকাল ইসমাইল খানের ছদ্মবেশে ওঁর বৌবাজারের ইকনমিক জুয়েলার্সের দোকানে গিয়েছিলাম—
হঠাৎ?
হঠাৎ ঠিক নয়—
তবে?
লোকটা চোরাই জুয়েলস্ ও সিথেটিক জুয়েলস্ অর্থাৎ নকল জহরতের কারবার করে, পূর্বে সেই রকম একটা কথা আমার কানে এসেছিল। তারপর গতকাল ঐ লোকটির কথাই শকুন্তলা দেবীর মুখে শুনে বিশেষ যেন সন্দিগ্ধ হয়ে উঠি। সোজা ইকনমিক জুয়েলার্সে চলে যাই। সেখানে ওর ঘরে বসবার টেবিলে একটা রেসকোর্সের বই দেখতে পাই, তারই ওপরে নির্ভর করে ঢিলটা ছুঁড়েছিলাম অন্ধকারে। কিন্তু যাই হোক, অনুমানটা যে আমার মিথ্যা নয় সে তো আপনিও কিছুক্ষণ আগে দেখলেন!