হ্যাঁ, আমি আপনাকে যেতে দিলেও পুলিস আপনাকে জেরা করতে ছাড়বে না, তারা আপনার জবানবন্দি নেবে। তবে ছাড়বে।
দুৰ্ভাগ্যক্রমে যখন এ ব্যাপারে জড়িয়ে পড়েছিই, জবানবন্দি আমার পুলিসকে দিতে হবে বৈকি, আর না দিলেই বা শুনছে। কে? কিন্তু আজকে রাতের মত আমায় যেতে দিন।
বেশ, তাহলে আপনি এখন যেতে পারেন।
যুবক আমার নির্দেশ পাওয়া মাত্র নিঃশব্দে ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।
কতক্ষণ সেই অন্ধকার হলঘরে নিঃশব্দে দাঁড়িয়েছিলাম মনে নেই, সহসা কার মৃদু স্পর্শে চমকে ফিরে চাইলাম, কে?
ভয় নেই, আমি কিরীটী। নীচে চল, রাত অনেক হয়েছে। দুজনে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলাম।
কিরীটী বললে, এই বুঝি তোমার কর্তব্যজ্ঞান সব্ৰত! যে কাজের জন্য তোমাকে পাঠালাম, তা একেবারে দেখতেও বেমালুম ভুলে গেলে? যাক গে, গুপ্তদ্বার যে নেই। ওঘরে সে বিষয়ে আমরা স্থিরনিশ্চিত হয়েছি। সেই ঘরটায় আপাততঃ তালা দিয়ে রাখা হয়েছে! কিন্তু যুবকটি কে?
কিরীটীর কথা শেষ হবার পূর্বেই বললাম, যুবকটিকে আমার এভাবে ছেড়ে দেওয়া উচিত হয়নি, এই কথাই তো এখন তুমি বলবে কিরীটী?
কিরীটী হাসতে হাসতে বললে, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। কিন্তু যাক, তুমি তার ঠিকানা তো রেখে দিয়েছ, সেই যথেষ্ট; যদিও ঠিকানা তার জানিবার তেমন দরকার ছিল না।
বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলাম, তার মানে?
ছেলেটির এক সময় প্রচুর বিষয়-সম্পত্তি ও নগদ টাকাকড়ি ছিল; এবং মাথায় হাত বুলিয়ে দু-চারজনে যা নিয়েছে তা গিয়ে এখনও হয়তো যা ব্যাঙ্কে আছে অনেকেরই তা নেই। কিন্তু ছেলেটির এর মধ্যেই দশজনের কৃপায় জাহান্নামে গেছে। আমার চিন্তাশক্তির যদি গলদ না থাকে, তবে নিশ্চয়ই ছেলেটি আমাদের নবলব্ধ বন্ধুবর কালিদাস শর্মার বর্তমান মনিব্যাগ। অর্থাৎ ওরই ঘাড় ভেঙে বর্তমানে বেকার প্রফেসার বন্ধটির আমাদের খাওয়া থাকা ও বিলাস-ব্যসনের সমস্ত খরচ চলেছে।
অ্যা! বল কি?
তাই।
***
সে রাতের মত মার্বেল প্যালেস থেকে বিদায় নিয়ে আমরা সকলে গাড়িতে এসে উঠে বসলাম।
রাত্রি শেষ হতে বড় বেশী দেরি নেই। একটা ঠাণ্ডা হাওয়া বিরবির করে বইছে। বর্ষণক্লান্ত মেঘমুক্ত আকাশটা যেন তারার মৃদু আলোয় ঝকঝক করছে।
০৯. নিঃশব্দ গতিতে জনহীন রাস্তা ধরে
নিঃশব্দ গতিতে জনহীন রাস্তা ধরে আমাদের গাড়ি হু-হু করে ছুটে চলল। গাড়িতে বসে আনমনে ভাবছিলাম। আজ রাত্রের সমগ্র ব্যাপারগুলো একটার পর একটা এখনো যেন চোখের ওপর ভেসে বেড়াচ্ছে ছায়াছবির মত। এবং আমার সমস্ত চিন্তাকে আবর্তিত করে একটা দৃশ্য মানসপটে কেবলই ভেসে উঠতে লাগল-লাল রক্তস্রোতের যেন ঢেউ খেলে যাচ্ছে, আর সেই রক্তের ঢেউয়ের মধ্যে কালো অক্ষরে একটা নাম মাথা তুলে জেগে উঠছে, আবার পরীক্ষণেই মিলিয়ে যাচ্ছে!…কালো ভ্ৰমর! কালো ভ্রমর!
আজ দীর্ঘ আট বছর ধরে একটা বিভীষিকার মতই ঐ নামটা যেন আমাদের পিছনে পিছনে তাড়া করে নিয়ে বেড়াচ্ছে।
কারও মুখেই কোন কথা নেই।
কিরীটী আনমনে কি ভাবছে তা সে-ই জানে।
আমাকে আমহাস্ট স্ট্রীটে নামিয়ে দিয়ে ‘শুভরাত্ৰি’ জানিয়ে কিরীটী চলে গেল। নিজেকে কেন জানি বড় ক্লান্ত ও অবসন্ন লাগিছিল। কোনমতে গায়ের পোশাকগুলো খুলে সোজা এসে শয়নকক্ষে প্রবেশ করলাম, রাজু বোধ হয় জেগেই ছিল, আমার পদশব্দে সে শয্যায় পাশ ফিরে শুতে শুতে বললে, এত রাত পর্যন্ত কোথায় ছিলি রে সুব্রত?
বিছানার ওপরে গা-টা এলিয়ে দিতে দিতে বললাম, বন্ধু, আমাদের পুরনো বন্ধু শ্ৰীযুক্ত কালো ভ্রমর আবার যে আবির্ভূত হলেন নাট্যমঞ্চে!
কে? চমকে রাজু শয্যার ওপরে উঠে বসল। —কে আবির্ভূত হয়েছে?
কালো ভ্ৰমর। কেন, এর মধ্যেই নামটা ভুলে গেলি নাকি?
রাজু আবার শয্যার ওপরে গা এলিয়ে দিল, ঠাট্টা করবার আর সময় পেলি না! এই শেষরাত্রে এসে…যা বাথরুম থেকে মাথায় চোখে মুখে ভাল করে ঠাণ্ডা জল দিয়ে আয়। কোথায় ঘুরিস এত রাত পর্যন্ত? বলতে বলতে রাজু বেশ ভাল করে পালকের লেপটা টেনে পাশ ফিরে বোধ করি চোখ বুজল।
আমিও আর কোন কথা না বলে খোলা জানলার দিকে ফিরে শুলাম। চোখের পাতায় যেন ঘুম আসছে না।
খোলা জানলাপথে শীতের অন্ধকার রাতের একটুকরো আকাশ চোখে পড়ল। শুকতারাটা দপদপ করে জ্বলছে।
ঝিরঝির করে রাত্রিশেষের শীতল হাওয়া ঘরে এসে ঢুকছে।
ঢং ঢেং ঢেং-দালানের ওয়াল-ক্লকটা রাত্রি তিনটে ঘোষণা করল।
উঃ, রাত্রি তিনটে বাজে!
চোখ বুজে ঘুমোবার চেষ্টা করতে লাগলাম।
কখন একসময় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না, পরদিন—
এই সুব্রত, ওঠু ওঠু! কিরীটীর ডাকে ঘুমটা ভেঙে গেল।
কখন এলে কিরীটী? লজ্জিত স্বরে বললাম।
***
আকাশে বাতাসে নাকি সমগ্র পৃথিবী জুড়ে এক মহাযুদ্ধের কালো ইশারা জেগে উঠেছে। ইংলণ্ড, জার্মান ও রাশিয়ার যে যুদ্ধ আজ সমগ্র ইউরোপকে তোলপাড় করছে, শীঘ্রই নাকি সারা পৃথিবীতে সেই যুদ্ধের আগুন ছড়িয়ে পড়বে। রাজু আর সনৎদা তাই ব্যবসায় নেমেছে। এত বড় সুবৰ্ণ সুযোগ!
বড়বাজারের মোড়ে প্রকাণ্ড লোহার কারবার-রায় অ্যাণ্ড রায় কোম্পানী। দিবারাত্র ওরা দুজন তাই নিয়েই ব্যস্ত।
আমার ওসব ব্যবসা-ট্যাবসা ভালও লাগে না, আনন্দও পাই না ওতে, তাই কিরীটীর সঙ্গে সঙ্গেই ফিরি।
বসবার ঘরে এসে আমি আর কিরীটী দু কাপ চা ঢেলে নিলাম। চা পানের পর কিরীটী আমার দিকে তাকিয়ে বললে, চল সুব্রত, আমার সঙ্গে একটু বেরুতে হবে।