এখনও সেটা বুঝতে পারেননি বিকাশবাবু? সব একসূত্রে গাঁথা—একই উদ্দেশ্যে একের পর এককে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছে রাজপরিবারের লোকেদরে এবং অন্য যারা খুন হয়েছে বাইরের তারাও সেই বিষচক্রের মধ্যে গিয়ে পড়েছে এবং যদি ঐ একের পর এক হত্যার মূল অনুসন্ধান করেন তো দেখতে পাবেন সবেরই মূলে রয়েছে এক মোটিভ বা উদ্দেশ্য, সব একই—অর্থম অনর্থ। কিন্তু যাক সে কথা। আমি শুধু সূত্রগুলো এখান থেকে ওখান থেকে একত্রে এক জায়গায় জড়ো করছি। সময় এলে ঐ সূত্রগুলো আপনার হাতে তুলে দেব। আপনি বোধ হয় জানেন না বিকাশবাবু, একটি অভাগিনী মায়ের কাতর মিনতিই আমাকে এই রায়পুর হত্যা-রহস্যের মধ্যে টেনে নিয়ে এসেছে। অবিশ্যি আইনের দিক থেকে তার ওপরে আগেই যবনিকা পড়েছে।
আপনি কি সত্যিই মনে করেন, ডাঃ সুধীন চৌধুরীকে খালাস করে আনতে পারা যেতে পারে?
মনে করি না বিকাশবাবু, সে বিষয়ে আমি স্থিরনিশ্চিত। কিন্তু তাহলেও বলতে দ্বিধা নেই, প্রথমে যখন এ কেসটা কতকটা ঝোঁকের মাথায়ই আমি হাতে নিই, তখন সব দিক ততটা ভাল করে বিবেচনা করে উঠতে পারিনি, আজ কিন্তু যেন মনে হচ্ছে, সুধীনকে মুক্ত করতে পারি তো আর একজনকে তার জায়গাতে যেতে হবেই। হয়তো একটা ভূমিকম্পও উঠবে, ফলে অনেক কিছুই ওলটপালট হয়ে যাবে।
কথা বলতে বলতে ওরা থানার কাছে এসে পড়েছিল; কিরীটী হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললে, রাত্রি প্রায় আড়াইটে। এখানকার কাজ আমার প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, কাল-পরশু নাগাদই বোধ হয় আমি চলে যাব। কাল সকালে একবার হারাধন মল্লিকের সঙ্গে দেখা করতে হবে। আপনিও আমার সঙ্গে থাকবেন কিন্তু। তারপর কতকটা যেন আত্মগত ভাবেই বললে নিম্নকণ্ঠে, তারপর বাকি থাকল একজন—
কার কথা বলছেন?
বলব পরে। কিন্তু হারাধন লোকটার কথাই ভাবি, অমন নিলোভ সত্যাশ্রয়ী লোক আজকালকার যুগে বড় বিরল মিঃ সান্যাল। হ্যাঁ ভাল কথা, হারাধনের নাতি জগন্নাথের সঙ্গে আপনার আলাপ আছে?
সুব্রতবাবু ওঁর খুব প্রশংসা করেন। বলেন, অমন ছেলে নাকি হয় না, একেবারে দাদু-অন্ত প্রাণ।
হ্যাঁ। কিরীটী মৃদুস্বরে জবাব দেয়।
ঐদিন রাত্রে শুতে যাবার আগে কিরীটী বলে, তারিণী চক্রবর্তী, মহেশ সামন্ত ও সুবোধ মণ্ডলকে কাল বিকেলের দিকে একবার এদিকে ডাকিয়ে আনতে পারেন? তাদের আমি কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই।
বেশ তো। নিশ্চয় আনাব।
***
পরের দিন গোটা নয়েকের সময় কিরীটী ও বিকাশকে ঘরে প্রবেশ করতে দেখে হারাধন সানন্দে ওদের আহ্বান জানালেন, আসুন আসুন। চা আনতে বলি?
তা মন্দ কি! হারাধনের ব্যাপার দেখে মনে হল যে, যেন এতক্ষণ উদগ্রীব হয়ে ওদেরই পথপানে চেয়েছিলেন। হারাধন চিৎকার করে ভৃত্যকে চা আনতে আদেশ দিলেন।
গতরাত্রের সব সংবাদ শুনেছেন বোধ হয় মল্লিক মশাই?কিরীটী মৃদুস্বরে বলে।
হ্যাঁ। শেষকালে নিশাও গেল। সব যাবে একে একে, এ আমি জানতাম কিরীটীবাবু। নিশা আমার চাইতে বছর আটেকের ছোট। বোলপুরে চাকরি করবার সময় মাঝে মাঝে চিঠিপত্র দিত। কিন্তু ইদানীং এখানে আসবার পর অনেক সময় ভেবেছি, যদি একবার দেখা হয়! তা আর হল না। শেষের দিকে হারাধনের কণ্ঠস্বর অশ্রুভারাক্রান্ত হয়ে যায় যেন।
মল্লিক মশায়? কিরীটী কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ ডাকে।
অ্যাঁ! কিছু বলছিলেন?
হ্যাঁ, আপনি কি সত্যি-সত্যিই ভেবেছিলেন নিশানাথও খুন হবেন?
নিশ্চয়ই। এ-কথা তো আমি হাজার বার বলেছি, সেইদিন থেকে, যখনই শুনেছি এই বৃদ্ধ বয়সে সে রূপালী চক্রের মধ্যে এসে ধরা দিয়েছে। কেউ থাকবে না, বুঝলেন কিরীটীবাবু, কেউ থাকবে না। রাজা রত্নেশ্বরের বংশে কেউ বাতি দিতে থাকবে না। এ বিধাতার অভিশাপ।
জগন্নাথ চায়ের ট্রেতে করে তিন পেয়ালা গরম চা নিয়ে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল।
কিরীটী আড়চোখে তাকিয়ে দেখল, জগন্নাথের মুখখানা যেন বেশ গম্ভীর। কিরীটী হাত বাড়িয়ে ট্রে থেকে চায়ের কাপ একটা তুলে নিতে নিতে মৃদুস্বরে বললে, জগন্নাথবাবু, আপনার দাদুকে নিয়ে আজ বা কাল হোক যে কোনো একসময় সময় করে রাজাবাহাদুর সুবিনয় মল্লিকের সঙ্গে দেখা করে আসবেন। তাঁদের আজকের এতবড় দুঃসময়ে সব ভুলে যাওয়াই ভাল। দূরসম্পকীয় হলেও, আপনারাই এখন তাঁর একমাত্র আত্মীয় অবশিষ্ট রইলেন তো।
না না, জগন্নাথ প্রবল প্রতিবাদ করে ওঠে, ও বাড়ির সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্কই আর নেই। রাজা শ্রীকণ্ঠ মল্লিকের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই সব ধুয়ে মুছে গেছে।
তা কি আর সত্যিই হয়, জগন্নাথবাবু? এ কি জলের দাগ যে এত সহজে মুছে যাবে? এ যে রক্তের সম্পর্ক, কিরীটী বলতে থাকে, জানেন তো, ইংরাজীতে একটা প্রবাদ আছে,—blood is thicker than water! ঝগড়া মিটিয়ে ফেলুন। অতীতে কে একজন ভুল করেছিলেন বলেই যে সেই ভুলের জের টেনে বেড়াতে হবে আজও বংশ-পরম্পরায় তার কি মনে আছে?
রক্তের দাগ বলেই তো মুছে ফেলবার নয় কিরীটীবাবু! জগন্নাথ জবাব দেয়।
কিন্তু–
কিরীটীকে বাধা দিয়ে জগন্নাথ মৃদু অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলে, বড়লোক আত্মীয় সাপের চেয়েও সাংঘাতিক কিরীটীবাবু। আপনি ধারণাও করতে পারবেন না, গরীব আত্মীয়দের ওরা কত হীন চোখে দেখে; দেখা-সাক্ষাৎ করতে গেলেই ওরা ভাবে যে হাত পাততে গেছি আমরা ওদের কাছে! আরও একটা কথা হচ্ছে, ওদের ঐ ধনগরিমার দৃষ্টি দিয়ে ওরা আমাদের মনে করে যেন কৃতার্থ করে দিচ্ছে, কিছুতেই সেটা যেন আমি সহ্য করতে পারি না, গায়ে যেন ছুঁচ বেঁধায়— তাছাড়া যে প্রাসাদে আমাদের সমান অধিকার একদিন ছিল, সেখানে আজ মাথা নীচু করে প্রবেশ করতে পারবো না। না–মরে গেলেও না। … উত্তেজনায় জগন্নাথ যেন হাঁপাতে থাকে।