মালতী দেবী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিরীটীর মুখের দিকে তাকালেন। যে চোখের দৃষ্টিতে কিরীটীর মুখের দিকে তাকালেন, সে চোখের দৃষ্টিতে কোনো সংকোচের বালাই ছিল না।
কিরীটী দৃঢ়স্বরে বলতে লাগল, শুনুন মা, এ রাজবাড়িতে আজ পর্যন্ত যা যা ঘটেছে সব একসূত্রে বাঁধা এবং তার কিনারা না করতে পারলে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড চলতেই থাকবে, তাই গোড়া থেকেই আমি শুরু করতে চাই।
মনে পড়ে আপনার মা, আপনার ছেলে সুহাসের মৃত্যুর আগে যেদিন তাকে নিয়ে আপনারা কলকাতা থেকে রায়পুরে আসছেন, সেদিন সকালের দিকে হঠাৎ এক সময় আপনি ও সুবিনয়বাবু সুহাসের ঘরে ঢুকে দেখতে পান, ডাঃ সুধীন চৌধুরী সুহাসকে একটা ইনজেকশন দিচ্ছেন। কোর্টেআপনিমামলার সময় ঐকথাই বলেছিলেন মনে পড়ে কিমা, আপনি নিশ্চয়ইভোলেননি! মামলার সময় জেরার মুখে বলেছিলেন, আপনি সুহাসকে প্রশ্ন করেছিলেন, কিসের আবার ইনজেকশন সে দিচ্ছে, তার জবাবে নাকি সুহাস কিছু বলেন নি!
হ্যাঁ, মৃদু ক্ষীণ ক্ষীণ স্বরে মালতী দেবী জবাব দেন।
আপনার ছেলের ঐ জবাবেই আপনি সেদিন সন্তুষ্ট হয়েছিলেন কি?
মালতী দেবী কিরীটীর প্রশ্নের কোনো জবাব দিলেন না, খোলা জানালাপথে অন্ধকারে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। অনেক কথাই রাণীমার বুকের মধ্যে যেন বরফের মত জমাট বেঁধে আছে। তাঁর একমাত্র পুত্র সুহাস! তাঁর জীবনের একটি মাত্র স্বপ্ন! তাও আজ বিফল হয়ে গেছে, শুধু স্মৃতিভারে আজও তিনি এইখানে পড়ে আছেন। কবে তিনি স্মৃতিমুক্ত হবেন!
মা! কিরীটী মৃদু স্নেহসিক্ত অথচ দৃঢ়কণ্ঠে বলতে লাগল, যে গেছে সে আর ফিরবে না। কিন্তু সন্তান, বিশেষ করে একটিমাত্র সন্তানকে হারানোর যে কী দুঃসহ ব্যথা তা আপনি মর্মে-মর্মেই জেনেছেন। অগাধ ঐশ্বর্যের অধীশ্বরী হয়েও আপনি আজ কাঙালিনী। মা হয়ে মায়ের ব্যথা আপনি নিশ্চয়ই বুঝবেন। আপনি জানেন নিশ্চয়ই এ কথা যে, আর যারই পক্ষে সম্ভব হোক, সুধীনের পক্ষে সুহাসকে খুন করা একেবারেই অসম্ভব!
অতীতকে আর টেনে আনবেন না। মালতী দেবী বললেন।
আমার নাম অর্জুন। আমি আপনার সন্তানের মত, অৰ্জুন বলেই আমাকে ডাকবেন। এবং তুমি বলেই সম্বোধন করবেন মা।
যা চুকেবুকে গেছে, তা আর কেন?
আমাদের সকলের উপরে এমন একজন আছেন জানবেন তাঁর সদা জাগ্রত দৃষ্টি থেকে টী তাঁর বিচার এখনও বাকি আছে। সত্যিকারের দোষী যে, একদিন তাকে মাথা পেতে দণ্ড নিতেই হবে।
কিন্তু—
একবার ভেবে দেখুন মা, সুধীনের মার কথা, তাঁরও তো ঐ একটি মাত্রই সন্তান!
না, আমি কিছু জানি না। আমি কিছু জানি না! সহসা মালতী দেবী দু হাতের পাতা চোখে ঢেকে রুদ্ধ আবেগে কেঁদে ফেললেন।
মা, আমার সত্যিকারের পরিচয় আপনি জানেন না, জানলে বুঝতেন মিথ্যা আশা এ জীবনে আমি কাউকে দিইনি। বলেছি সুধীনের মাকে, সুধীন আবার তাঁর মার বুকে ফিরে যাবেই। আপনি জানেন না, কিন্তু আমি জানি, সুধীন আদালতে বিচারের সময় অনেক কথার যে জবাব দিতে অস্বীকার জানিয়েছিল, সে কেবল আপনাকেই বাঁচাতে। পাছে আপনাকে গিয়ে প্রত্যহ কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয় এবং আপনার মাথা নীচু হয়, সেই ভয়ে এবং আপনার ছেলে মৃত সুহাসের প্রতি অসীম স্নেহের বশেই সে সব কিছুই প্রায় অস্বীকার করে বা না-জানার ভান করে নিজের পায়ে নিজেই কুঠার মেরেছিল। একবার ভেবে দেখুন তো, এ কত বড় ত্যাগ-স্বীকার! আর আপনি? তার এত বড় ত্যাগের কি প্রতিদান দিয়েছেন!
কে? কে তুমি?… কি চাও? ভীতচকিত কণ্ঠে মালতী দেবী প্রশ্ন করেন হঠাৎ।
আমি? কিরীটী মৃদু হাসলে, পরিচয়টা আজ আমার ভোলাই থাক মা। সময় হলেই সব জানতে পারবেন। হ্যাঁ, আপনি যেতে পারেন মা, আপনি অত্যন্ত পরিশ্রান্ত হয়েছেন।
কিন্তু–, মালতী দেবী ইতস্তত করতে থাকেন।
আমার যতটুকু আপনার কাছে জানবার ছিল জেনেছি, আপনি এবারে যেতে পারেন মা।
কতকটা যেন একপ্রকার টলতে টলতেই মালতী দেবী দরজার দিকে অগ্রসর হলেন। কিরীটী তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে নিজ হাতে দরজা খুলে রাস্তা করে দিল। মালতী দেবী ঘর হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন।
পাশের ঘরে একটা সোফার উপরে বিকাশ বসে বসে ঝিমাচ্ছিল, আর সুবিনয় অস্থির পদে ঘরময় পায়চারি করছিলেন।
বিকাশবাবু!
কিরীটীর ডাকে বিকাশ ধড়ফড় করে উঠে বসে, অ্যাঁ!
চলুন রাজাবাহাদুর, এবারে মৃতদেহটা দেখে আসা যাক।
আগে আগে রাজাবাহাদুর, পিছনে কিরীটী ও বিকাশ অগ্রসর হল।
সিঁড়ি দিয়ে নেমে একতলায় এসে অন্য একটা ঘোরানো সিঁড়িপথে, দোতলা ও একতলার মাঝামাঝি একটি বদ্ধ ঘরের দরজার সামনে এসে সকলে দাঁড়াল। ঘরের দরজার শিকল ভোলা ছিল, রাজাবাহাদুরই শিকল খুলে দরজা ঠেলে আহ্বান জানালেন, আসুন—এই ঘর।
সকলে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল, ঘরের মধ্যে উজ্জ্বল বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলছে। মাঝারি গোছের ঘরখানি।
আসবাবপত্র তেমন বিশেষ কিছুই নেই, একটি পালঙ্ক, তার উপরে শয্যা বিছানো। একটি শ্বেতপাথরের টীপয়। ঘরের কোণে একটি মাঝারি সাইজের কাঁচের আয়না বসানো আলমারি, একটি বুক-সেলফ ও একটি মাত্র ক্যাম্বিসের আরাম-কেদারা।
ঘরের মধ্যে একটি দরজা ও দুটি জানালা। দুটি জানালাই ভোলা। একটি খোলা জানালার সামনে উপুড় হয়ে একপাশে কাত হয়ে ধনুকের মত বেঁকে নিশানাথের মৃতদেহটা পড়ে আছে, হাতের ও পায়ের আঙুলগুলো দুমড়ে বেঁকে গেছে। মুখে একটা অস্বাভাবিক যন্ত্রণার চিহ্ন তখনও সুস্পষ্ট।