দুবৎসরের শিশু জগন্নাথকে বুকে করে হারাধন রায়পুরে ফিরে এলেন কলকাতা থেকে। এই ঘটনার মাস গরেক বাদে চিন্ময়ের মা-ও মারা গেলেন। ছোট্ট শিশু জগন্নাথের সমস্ত ভার এসেহারাধনেরমাথায় পড়ল। বুকে-পিঠেকরেহারাধন জগন্নাথকে মানুষ করতে লাগলেন।
যত বয়স বাড়ছিল হারাধনের স্বভাবটাও খিটখিটে হয়ে যাচ্ছিল।
জগন্নাথও অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র, কিন্তু অত্যন্ত খেয়ালী প্রকৃতির। এম. এ. পড়তে পড়তে দাদুর অসুখের সংবাদ পেয়ে সেই যে মাস পাঁচেক আগে সে বাড়িতে এসেছে, আর কলকাতায় ফিরে যায়নি।
সে এবারে বাড়িতে পা দিয়েই বুঝেছিল, দাদুর মাথার গোলমালটা একটু বেশী বেড়েছে। সর্বদা তাঁকে চোখে চোখে রাখা একান্ত প্রয়োজন।
.
চা পান করতে করতে জগন্নাথ সুব্রতর সঙ্গে কথাবার্তা বলছিল।
সুব্রতর জগন্নাথকে প্রথম পরিচয়ের মুহূর্তেই ভাল লেগেছে।
স্বল্পভাষী তীবুদ্ধি ছেলেটির একটি অদ্ভুত আকর্ষণী শক্তি আছে।
জগন্নাথ বলছিল, দাদুর কথায় আপনি নিশ্চয়ই কিছু মনে করেননি কল্যাণবাবু?
না না–সে কি!
দাদু আমার দেবতার মত লোক, আমার মা বাবা ও দিদার মৃত্যুর পর হতেই অমনি মাথাটা ওর গোলমাল হয়ে গেছে।
সুব্রত তার আসল উদ্দেশ্য গোপন রেখে জগন্নাথকে জানিয়েছিল, চাকরির উমেদারি নিয়ে সে রায়পুরে এসেছে। আবার কলকাতায় ফিরে যাবে।
পরের দিন সকালে ডাঃ মুখার্জীর সুপারিশপত্রটি নিয়ে জগন্নাথের নির্দেশমত সুব্রত রাজবাড়িতে গিয়ে হাজির হল।
রাজাবাহাদুর সুবিনয় মল্লিক, রায়পুর স্টেটের একচ্ছত্র অধীশ্বর, তখন তাঁর খাস কামরাতেই ছিলেন। ভৃত্যের হাত দিয়ে সুব্রত সুপারিশপত্রটি রাজাবাহাদুরের কাছে পাঠিয়ে দিল। আধঘণ্টা বাদেই সুব্রতর ডাক পড়ল খাস কামরায়।
সুব্রত ভৃত্যের পিছু পিছু রাজাবাহাদুরের খাস করায় এসে প্রবেশ করল।
প্রকাণ্ড একখানি হলঘর-বহু মূল্যবানআধুনিক আসবাবপত্রে সুসজ্জিত।
একটি সুদৃশ্য দামী আরামকেদারায় শুয়ে রাজাবাহাদুর আগের দিনের ইংরাজী সংবাদপত্রটি পড়ছিলেন।
লোকটির বয়স চল্লিশের ঊর্ধ্বে। কিন্তু অত্যন্ত স্বাস্থ্যবান বলিষ্ঠ চেহারা, কাঁচা হলুদের মত গায়ের রং। দামী মিহি ঢাকাই ধুতি পরিধানে, গায়ে পাতলা সিল্কের গেঞ্জি। চোখে সোনার ফ্রেমের চশমা।
সুব্রত কক্ষে প্রবেশ করে নমস্কার জানাল।
বসুন, আপনারই নাম কল্যাণ রায়?
আজ্ঞে।
আপনি ডাঃ মুখার্জীর পরিচয়পত্র এনেছেন, আপনাকে আমি কাজে বহাল করছি। আপাতত পাঁচশত টাকা করে পাবেন, কিন্তু you look so young–বলতে বলতে পাশের শ্বেতপাথরের টিপয়ের ওপরে রক্ষিত কলিংবেলটা বাজালেন।
ভৃত্য এসে ঘরে প্রবেশ করতে বললেন, এই, সতীনাথবাবুকে ডেকে দে।
একটু পরেই সতীনাথবাবু এসে ঘরে প্রবেশ করলেন। সতীনাথের বয়স ত্রিশের বেশী নয়। ঢ্যাঙা, লম্বা চেহারা, মুখটা ছুঁচালো। মাথায় কোঁকড়া ঘন চুল, ব্যাকব্রাস করা। সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য তাঁর চক্ষু দুটি। দৃষ্টি যেন অন্তর পর্যন্ত ভেদ করে যায়। দাড়িগোঁফ নিখুঁতভাবে কামানো।
সতীনাথ, এঁর নাম কল্যাণ রায়। ডাক্তার মুখার্জী এঁকে পাঠিয়েছেন, একেই আমি স্টেটের সুপারভাইজার নিযুক্ত করলাম। স্কুল-বাড়ির পাশে যে ছোট একতলা বাড়িটা আছে, সেখানেই এঁর ব্যবস্থা করে দিও। হ্যাঁ ভাল কথা, আপনি বিবাহিত কি?
আজ্ঞে না।
বেশ, তাহলে আপনি আজ আসুন, কাল সকালের দিকে আসবেন কাজের কথাবার্তা হবে। আপনি উঠেছেন কোথায়?
কোথাও না। স্টেশনে আমার মালপত্র রেখে এসেছি।
তবে আর দেরি করবেন না, জিনিসপত্র নিয়ে আসুন।
বেশ।
সতীনাথ, দুজন লোক দিয়ে দাও ওঁর সঙ্গে।
না, তার কোনো প্রয়োজন নেই। সামান্য মালপত্র, আমি নিজেই নিয়ে আসতে পারব। বেশ।
সুব্রত ইচ্ছে করেই হারাধনের ওখানে ওঠকম ব্যাপারটা গোপন করে গেল। সে রাজাবাহাদুরকে নমস্কার জানিয়ে সতীনাথবাবুর সঙ্গে ঘর হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে এল।
১.১০ অদৃশ্য ছায়া
পরের দিন রাত্রে সুব্রত কিরীটীকে চিঠি লিখছিল :-
কিরীটী,
চাকরি এক চিঠিতেই মিলে গেছে। পুরাতন রাজবাড়ির কাছেই থাকবার জন্য কোয়ার্টার মিলেছে। কাজের কথা বিশেষ এখনও কিছু হয়নি। তবে সামান্য আলাপে অনুমানে যা বুঝেছি, বর্তমানে স্টেটের মধ্যে পুকুরচুরি হচ্ছে, তারই উপর আমায় গোয়েন্দাগিরি করতে হবে, রাজাবাহাদুরের পক্ষ হতে। অত্যন্ত সন্দিগ্ধমনা লোক এই রাজাবাহাদুর।
ডাঃ অমিয় সোমের সঙ্গে সামান্য মৌখিক আলাপ হয়েছে। মনে হল সাধারণ নয়। গভীর জলের মাছ।
তারপর আমাদের সতীনাথ লাহিড়ী মশাই, তাঁর পরিচয় দিতে সময় লাগবে। তাঁর চোখের দৃষ্টিটা বড় সাংঘাতিক বলে মনে হয়। এবং মনে হয় একটি আসল শিয়াল চরিত্রের মানুষ! ঈশপের গল্পের সেই শিয়াল ও বোকা কাকের গল্প মনে আছে? তারপর রায়পুর জায়গাটা, এর কিন্তু আমার মতে রায়পুর নাম না দিয়ে শালবনী নাম দেওয়াই উচিত ছিল।
শালবনের ওপারে আছে একটি ঘন জঙ্গল। শোনা যায় বন্যরা ও ব্যাঘ্রের উৎপাতও মাঝে মাঝে হয় সেখানে, তবে ভাল শিকারী নেই এই যা দুঃখ। একটা যদি দোনলা বন্দুক পাঠাস, শিকার করে আনন্দ পেতাম। ওদিককার সংবাদ কি?
তোর কল্যাণ
***
দিন দুই বাদে সুব্রতর চিঠির জবাব এল।
সু–তোর দুটো চিঠিই পেলাম। দোনলা বন্দুক চাস পাঠাব। কিন্তু রাজবাড়ির মোহে হারাধনকে হেলা করিস না। He is a jewel—একেবারে খাঁটি হীরে। তার পর আমাদের পূজ্যপাদ লাহিড়ী মশাই। তোর দৃষ্টিশক্তির প্রশংসা করি। জানিস না বোধ হয়, ডাক্তারী শাস্ত্রে চক্ষুকে সজীব ক্যামেরার সঙ্গে তুলনা করে? রায়পুরের নামটা তো আমাদের হাতে নয়, আর আমাদের মোকররী স্বত্বও ওতে নেই, অগত্যা শালবনী নাম ছেড়ে রায়পুরই বলতে হবে। ভাল করে সন্ধান নে দেখি পুকুরচুরির সিঁধকাঠিটা কার হাতে ঘোরে? হ্যাঁ ভাল কথা, ওখানকার অধিবাসীদের মধ্যে, মানে রাজাবাহাদুরের প্রজাবৃন্দের মধ্যে, সাঁওতাল জাতটা আছে কি? অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সংবাদ এটা, পরপত্রে যেন পাই-তোর ক।