না, সেসব কিছুই আমার জানা নেই হয়তো সুকুমার জানে।
সুকুমার মানে শরদিন্দুবাবুর জ্ঞাতিভাই, যিনি এই বাড়িতেই থাকেন?
হ্যাঁ। একটা কথা রায়মশাই কথাটা আমি বলিনি এখনও, কিন্তু বোধ হয় আপনার জানা দরকার, আমার মেয়ে মানসীর সঙ্গে ঐ ছেলেটির একটু যেন হৃদ্যতা গড়ে উঠেছিল একসময়
ভালোবাসা?
বলতে পারেন।
আপনার মেয়ের বিবাহের পূর্বে না পরে?
পূর্বে।
তবু আপনি শরদিন্দুবাবুর সঙ্গে মেয়ের বিবাহ দিয়েছিলেন কেন?
সে কথা তো পূর্বেই আপনাকে বলেছি শরদিন্দু এক সময় আমার মালিক ছিল—তারপর হঠাৎ অকালে শরদিন্দু আমাকে রিটায়ার করাবার জন্য জেদ প্রকাশ করল-মানসী সেকথা জেনে প্রতিবাদ জানাতে যায় শরদিন্দুর কাছে শরদিন্দু ওকে দেখে মুগ্ধ হয়—বিবাহের প্রস্তাব দেয় আমার কাছে, সেই সঙ্গে একটা লোভনীয় পেনসনের লোভ দেখায়। চাকরি গেলে আমার আর্থিক অবস্থার কি হবে ভেবে আমি মানসীকে অনুরোধ জানাই বিবাহে সম্মত হতে। মানসী আমায় অত্যন্ত ভালোবাসত—সে সব কথা শুনে প্রথমটার গুম হয়ে রইল—তারপর একটু পরে বলল, ঠিক আছে, তাই হবে বাবা।
কয়েকটা মুহূর্ত চুপ করে থেকে কিরীটী বললে, আচ্ছা বিবাহের পর শরদিন্দু কি ব্যাপারটা জানতে পেরেছিল—মানে তার স্ত্রীর পূর্বরাগের কথা?
বোধ হয় জেনেছিল।
আপনি জানলেন কি করে?
মানুর ডাইরি থেকে—
ডাইরি?
হ্যাঁ, মানুর একটা ডাইরি ছিল—মধ্যে মধ্যে যে ডাইরি লিখত। সেই ডাইরিটা এখনও আমার কাছে আছে।
আপনি পেলেন কি করে সেই ডাইরি?
ও যেবারে পুরী যায়, তার দুদিন আগে আমার কাছে এসেছিল—বোধ হয় সেই সময়ই ডাইরিটা তার পড়ার টেবিলে বইয়ের মধ্যে রেখে যায়—তার মৃত্যুর পর একদিন তার পড়ার টেবিলের বইগুলো ঘাঁটতে ঘাঁটতে হঠাৎ ডাইরিটা পাই—ওর পুরী যাওয়ার তিন দিন আগে রাত্রে ডাইরির শেষ পাতা লেখা।
আপনি আমাকে একবার ডাইরিটা পড়াতে পারেন নন্দীমশাই?
কাল এনে দেব।
তাই দেবেন, আগে আমি ডাইরিটা পড়ে দেখি, ডাইরির মধ্যে যদি এমন কিছু পাইযাতে করে আপনার সংশয়টা যুক্তিযুক্ত মনে হয়
পরেশ নন্দী বললেন, বেশ, তাই পড়ে দেখুন কালই আমি দিয়ে যাব। ডাইরিটা—পরেশ নন্দী কথাগুলো বলে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
ঐদিনই সন্ধ্যার দিকে পরেশ নন্দী এসে মানসীর ডাইরিটা কিরীটীর হাতে তুলে দিয়ে গিয়েছিল। ১৯৬০ সনের একটা পুরাতন ডাইরি। সেই ডাইরির পাতার মধ্যে মধ্যে মানসী ডাইরি লিখেছে। রাত্রে বসবার ঘরের সোফাটায় বসে কিরীটী ডাইরির পাতাগুলি ওলটাচ্ছিল।
প্রথম তারিখ ১৯৬৩ সনের ৬ই জুলাই। প্রথমে বেশ অনেকগুলো খালি পাতার পর বোধ হয় ঐ ডাইরি লেখা শুরু। মানসী লিখছে, মাত্র কয়েকটি লাইন—আজ আমার জন্মদিন, রথযাত্রার দিনই নাকি আমি জন্মেছিলাম—ঠিক সন্ধ্যা সোয়া সাতটায়, হিসাব করে দেখলে আজ আমার বয়স উনিশ পূর্ণ হল, কুড়ি বছরে পা দিলাম!
পরের ডাইরি লেখা হয়েছে—এক মাস পরে—৭ই আগস্ট। বুধবার।
সকাল থেকেই আকাশ মেঘলা হয়ে আছে। কাল সারারাত বৃষ্টি পড়েছে। বৃষ্টি আমার খুব ভাল লাগে, বৃষ্টির যেন একটা আলাদা সুর আছে রিম ঝিম রিম ঝিম।
তারপরের যে তারিখটায় ডাইরি লেখা শুরু হয়েছে লাল কালি দিয়ে সে তারিখটা লেখা। তারিখটা ইংরেজী তারিখ নয়, বাংলা তারিখ। ২১শে ফায়ূন, রাত্রি দশটা।
আজ স্নানের পর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রথম আবিষ্কার করলাম যেন। বাড়িতে কেউ ছিল না। আমি একাই ছিলাম। সত্যি আমি দেখতে এত সুন্দুর? দেহের কানায় কানায় যৌবন। আমি নিজেই যেন চমকে উঠেছিলাম নিজের সেই ভরা যৌবনের দিকে তাকিয়ে
ঐ পর্যন্তই, তারপর আর কিছু লেখা নেই।
লেখা শুরু আবার সাত মাস পরে।
এবারে পুজো আশ্বিনের মাঝামাঝি। আকাশে এখনও মধ্যে মধ্যে মেঘ জমে ওঠে। দু-এক পশলা বৃষ্টিও হয়। আচ্ছা সুকুমারকে কি সত্যিই আমি ভালোবাসি? কি জানি, জানি না। তবে এটা জানি, সুকুমার আমাকে ভালোবাসে।
বুঝতে পারি দেখা হলে সুকুমার কি রকম মুগ্ধ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। ওর দুচোখের দৃষ্টি যেন আমাকে বন্দনা করে। সুকুমার কিন্তু বড় চাপা। আচ্ছা, মুখ খুলতে ওর এত ভয় কেন, কিসেরই বা ভয়?
আবার দু মাস পরে লেখা ডাইরি।
লেকে আজ বেড়াতে গিয়েছিলাম দুজনে। আমি আর সুকুমার দুজনে একটা বেঞ্চে পাশাপাশি বসেছিলাম, ও আমার একটা হাত দুহাতের মধ্যে নিয়ে খেলা করছিল। সন্ধ্যার অন্ধকারে চারিদিক ঝাপসা হয়ে গিয়েছে, কারও মুখ স্পষ্ট দেখা যায় না। বললাম আমিই, কিছু বলবে সুকুমার?
সুকুমার বললে, কি বলব?
কিছু বলার নেই?
তুমি বল মানসী। সুকুমার বলল।
কেন, তুমি বলতে পার না সুকুমার?
যা বলবার আগেই তো সব বলেছি। কেন, তুমি জান না! শুনতে পাওনি?
কই না তো!
তবে আর শুনে কাজ নেই।
বাবুর অমনি রাগ হয়ে গেল, বেশ, গো বেশ আমি হার মানছি, হল তো?
সুকুমার হঠাৎ দুহাত বাড়িয়ে আমাকে বুকের মধ্যে টেনে নিল।
আঃ, কি হচ্ছে ছাড়—কেউ দেখে ফেলবে, বললাম।
আরও মাস দুই পরে আবার ডাইরি লেখা। কোন তারিখ নেই। তবে লেখা :
দুমাস কোন ডাইরি লিখিনি।
আশ্চর্য, সত্যি আজও যেন সুকুমারকে বুঝতে পারলাম না। ও আমাকে চায়, বুঝতে পারি, কিন্তু বলে না স্পষ্ট করে—এ এক দুঃসহ যন্ত্রণা-ভোগ। এক যন্ত্রণার সাগর উত্তীর্ণ হওয়া। তবে ওর ভালোবাসাটা ও প্রকাশ করতে পারে না। কেন পারে না ও—আমি তো পারি, ও ছাড়া জীবনে আমার অন্য কোন পুরুষ আসতে পারে না।