চা ও প্রাতঃরাশ গোকুল ওপরেই নিয়ে এল ট্রেতে করে, চা পান করতে করতে হঠাৎ কেন যেন আজ আবার মনে হল সুকুমারের, এ বাড়ি ছেড়ে বোধ হয় তার চলে যাওয়াই ভাল—আজ হোক কাল হোক শরদিন্দুকে কথাটা সে বলবে।
দুজনের আবার দেখা হল বেলা প্রায় পৌনে একটা নাগাদ কারখানায়। জার্মানী থেকে অনেক টাকার নুতন একটা প্ল্যান্ট আনা হয়েছে। সেটারই তদারক করছিল সুকুমার, শরদিন্দু এসে ঢুকল। সুকু!
সুকুমার শরদিন্দুর দিকে ফিরে তাকাল। বললে, এই প্ল্যান্টটা গত মাসে এসেছে শরদিন্দুদা—
শরদিন্দু কিন্তু সেদিকে ফিরেও তাকাল না। সম্পূর্ণ অন্য প্রসঙ্গ তুলল, লাঞ্চে যাবি না?
আমি তো লাঞ্চে বাড়িতে যাই না, এখানেই ক্যানটিনে লাঞ্চ করি।
শরদিন্দু বললে, নতুন একজন সায়েন্টিস্ট দেখলাম এখানে, অনিল গাঙ্গুলী—
হ্যাঁ, ওঁকে তো তুমিই মাস দুয়েক আগে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়ে গিয়েছিলে—
ও হ্যাঁ–তা তিনি কাজ কেমন করছেন?
মনে তো হয় ভালই।
আচ্ছা চলি—শরদিন্দু বের হয়ে গেল।
সুকুমার একবার ইচ্ছা হয়েছিল প্রশ্ন করে শরদিন্দুকে, সে নাকি আজকাল পেথিডিন নেয়, কিন্তু কেন জানি কথাটা তার মুখ দিয়ে বেরুল না।
তারপর আরও পনেরো দিন চলে গেল—কথাটা জিজ্ঞাসা করতে পারল না শরদিন্দুকে সুকুমার। চলে যাবার যে ইচ্ছাটা তার মনে জেগেছিল, সেটাও প্রকাশ করা হল না।
০৫. ঘটনাটা ঘটল আরও মাসখানেক পরে
ঘটনাটা ঘটল আরও মাসখানেক পরে। দীঘায় বেড়াতে গিয়েছিল শরদিন্দু রীণাকে নিয়ে–দিন চারেক পরে ফিরে এল একা।
সুকুমার তিনতলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে নামছিল, হঠাৎ শরদিন্দুর দিকে তাকিয়ে থমকে দাঁড়াল। উসকো-খুসকো মাথার চুল, ছোট ছোট দাড়ি। দুচোখে কেমন যেন বিভ্রান্ত দৃষ্টি। নিঃসন্দেহে। চমকে উঠেছিল সুকুমার।–কি হয়েছে শরদিন্দুদা!
রীণা নেই।
নেই? কি বলছ তুমি?
বোধ হয় সমুদ্রের জলে ড়ুবে মারা গেছে।
সমুদ্রের জলে ড়ুবে?
হ্যাঁ, স্নান করতে নেমেছিল-সন্ধ্যার ঘোর নামছে তখন, কত বারণ করলাম শুনল না আমার কথা। জল থেকে আর উঠল না। পরের দিন কত খুঁজলাম—জেলেরা কত চেষ্টা করল
পুলিসে খবর দিয়েছিলে? সুকুমার শুধাল।
হ্যাঁ, তারা এখন ডেড বডিটার অনুসন্ধানে আছে।
সুকুমার কি বলবে বুঝে পায় না, কোন সান্ত্বনার বাণী তার মুখ থেকে বের হয় না।
আরও দিন পনেরো কেটে গেল। রীণার মৃতদেহের সন্ধান করতে পারেনি পুলিস, যেমন পারেনি পুরীতে মানসীর মৃতদেহের কোন সন্ধান।
মানসীর মৃত্যুর ব্যাপারটাও নিয়ে পরবর্তীকালে যেমন শরদিন্দু আর মাথা ঘামায়নি, তেমনি রীণার মৃত্যুর ব্যাপারটাও বোধ করি অনিবার্য একটা দুর্ঘটনা বলে শরদিন্দু মেনে নিয়েছিল।
কিন্তু মানসীর ঐ আকস্মিক মৃত্যুর ব্যাপারটা ভুলতে পারেননি একজন, তিনি মানসীর বাবা পরেশ নন্দী। একটা সন্দেহের কুয়াশা যেন ক্রমশ তার মনের মধ্যে জমাট বেঁধে উঠতে থাকে। মানসী ছিল ভাল সাঁতারু। কলেজ জীবনে সে তার সাঁতারের কৃতিত্ব স্বরূপ অনেক কাপ মেডেল পেয়েছিল। সেই মানসী পুরীর সমুদ্রে স্নান করতে নেমে তলিয়ে যাবে—কথাটা যেন মন থেকে কিছুতেই পরেশ নন্দী মেনে নিতে পারছিলেন না।
কেমন যেন ব্যাপারটা রীতিমত অবিশ্বাস্য মনে হত তার কাছে। মনে হত মানসীর মৃত্যুর মধ্যে কোথাও একটা কোন রহস্য আছে নিশ্চয়ই।
এমনি যখন মনের অবস্থা পরেশ নন্দীর, হঠাৎ একজনের কথা তার মনে পড়ল। মানুষটি সম্পর্কে অনেক কিছু তিনি শুনেছিলেন কিন্তু সাক্ষাৎ পরিচয় ছিল না। অবশেষে অনেক ভেবে সাহসে ভর করে একদিন তিনি গড়িয়াহাটায় তার গৃহে গিয়ে উপস্থিত হলেন।
কিরীটী রায়।
কিরীটী বাড়িতেই ছিল। প্রাতঃভ্রমণ শেষ করে সবে ফিরেছে কিরীটী। বসবার ঘরে বসে ঐদিনকার সংবাদপত্রের পাতাটা ওলটাচ্ছিল কিরীটী, জংলী এসে বললে, একজন বুড়ো বাবু তোমার সঙ্গে দেখা করতে চায়।
বুড়ো বাবু? কিরীটী বলল, তুই বললি না কেন কারও সঙ্গে আমি দেখা করি না?
বলেছি, কিন্তু শুনছে না
যা এই ঘরে নিয়ে আয়।
একটু পরে জংলীর সঙ্গে পরেশ নন্দী এসে ঘরে ঢুকলেন, পরনে একটা ময়লা ধুতি আর পাঞ্জাবি, চোখে চশমা, পায়ে চপ্পল।
রায়মশাই, আপনাকে বিরক্ত করতে আসতে হল বলে আমি বিশেষ দুঃখিত, কিন্তু আপনি ছাড়া কেউ আমাকে সাহায্য করতে পারবেন না ভেবেই
বসুন। কোথা থেকে আসছেন?
পরেশ নন্দী তার নাম-ধাম বললেন।
আমার কাছে কি দরকার বলুন তো পরেশবাবু? কিরীটী শুধাল।
আমার যা বলবার যদি একটু ধৈর্য ধরে শোনেন রায়মশাই অনুগ্রহ করে—
বেশ বলুন!
পরেশ নন্দী, তখন মানুসীর কাহিনী আদ্যোপান্ত বলে গেলেন ধীরে ধীরে।
আপনি বিশ্বাস করতে পারছেন না নিশ্চয়ই নন্দীমশাই যে আপনার মেয়েটি জলে ড়ুবে মরতে পারে! কিরীটী বলল সবকিছু শুনে।
না। আমার মনে হয় তার যদি মৃত্যুই হয়ে থাকে জলে ড়ুবে, তাহলে সে মৃত্যু স্বাভাবিক নয়।
সমুদ্রে কখনও আপনার মেয়ে সাঁতার কেটেছে?
না।
তাহলে ব্যাপারটা তো আকস্মিক দুর্ঘটনাও হতে পারে নন্দীমশাই।
পরেশ নন্দী বললেন, হতে যে পারে না তা নয়। কিন্তু তবুও মনকে প্রবোধ দিতে পারছি। তাছাড়া একটা কথা ভেবে দেখুন রায়মশাই-শরদিন্দু আবার বিবাহ করল দেড় বৎসরের মধ্যে এবং তার দ্বিতীয় স্ত্রীর ভাগ্যেও অনুরূপ ব্যাপার ঘটল। আবার সেই সমুদ্র–
আচ্ছা নন্দীমশাই, শরদিন্দুবাবু দ্বিতীয়বার যাকে বিবাহ করলেন—সেই রীণা না কি নাম মেয়েটির—তার পরিচয় কিছু জানেন? কার মেয়ে—কোথায় বিয়ে করলেন তাকে উনি?