শরদিন্দু বলল, বেশ তো, তাই ডেকো।
ও কি, এখনও তুমি চায়ের কাপ সামনে নিয়ে বসে আছ? কখন চা দিয়ে গিয়েছি আমি তোমায়।
স্ত্রীর কথায় শরদিন্দু চায়ের কাপটা টেনে নিতে যেতেই মানসী বাধা দিল, থাক, ও চা আর খেতে হবে না—আমি আবার চা তৈরি করে দিচ্ছি।
গোকুল ঐ সময় ট্রেতে করে টি-পট, মিল্ক-পট ও চিনির পাত্রে চিনি নিয়ে ঘরে ঢুকল।
তোমার বাবুর অমলেট ভেজেছ?
হ্যাঁ।
হঠাৎ শরদিন্দু ব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল, তোমরা চা খাও মণি, আমি একটা জরুরি ট্রাংক কল বুক করেছি ঘণ্টাখানেক আগে, দেখি সেটা দেরি হচ্ছে কেন।
শরদিন্দু দাঁড়াল না। ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
সুকুমার বোবা হয়ে বসে থাকে।
কি ব্যাপার সুকুমার—সুকুমার বলে ডাকব বলায় কি রাগ করলে নাকি?
সুকুমার কোন জবাব দেয় না।
কাপে চা ঢেলে চিনি মিশিয়ে দুধের কাপটা এগিয়ে দিতে দিতে সুকুমারের দিকে চেয়ে মানসী বলল, কি হল, অত গম্ভীর কেন?
মানসী, আমি ভাবছি মেসে চলে যাব।
ওমা, সে কি! মেসে কেন যাবে?
তুমি যখন কিছুই বুঝতে চাও না, বোঝবার ইচ্ছেও নেই—
দূরে সরে গেলেই কি আমাকে ভুলতে পারবে সুকুমার?
মানসী, তুমি কি এতটুকু সিরিয়াস হতে পার না!
বিশ্বাস কর সুকুমার, আমার মত সিরিয়াস কম মেয়েই পাবে। তারপর কিছুক্ষণ থেমে বললে, আমিও তো মানুষ সুকুমার। আমারও তো মন বলে একটা পদার্থ আছে!
সুকুমারের মনে হল শেষের দিকে মানসীর গলাটা যেন ধরে এল।
মানসী তাকাল সুকুমারের দিকে। তার দুই চোখে জল টলটল করছে।
আমার বোধ হয় এখান থেকে চলে যাওয়াই ভাল–
আমার শেষ কথা শোন সুকুমার, তুমি যদি এখান থেকে চলে যাও—আমি জেনো ঠিক সুইসাইড করব।
ঐ সময় শরদিন্দু ঘরে এসে ঢুকল।
মানসী, আমরা কালই পুরী রওনা হচ্ছি! শরদিন্দু বললে, সমুদ্র তো তুমি কখনও দেখনি!
দেখেছি।
দেখেছ–? কবে?
কবে কি—অনেকবার আমি সমুদ্র দেখেছি—উত্তাল সেই ঢেউয়ের মধ্যে কত দিন মনের আনন্দে ভেসে বেড়িয়েছি। ঢেউয়ের মাথায় দোদুল দোলায় দুলেছি, মানসী বলে, সমুদ্র আমার অনেক দিনের স্বপ্নের সমুদ্র সমুদ্রের সেই অতল জলের তলায় যেন হারিয়ে গিয়েছি আমি
শরদিন্দু গম্ভীর হয়ে এবারে বললে, ঠিক আছে! এবারে আর স্বপ্ন নয়, তুমি সত্যি সত্যি সমুদ্র দেখবে।
ঐদিনই সন্ধ্যার পর সুকুমারের সেদিন শরীরটা খারাপ। কোথাও বের হয়নি, নিজের ঘরে একটা আরামকেদারায় বসে একটা ইংরেজী বই পড়ছিল। মানসী এসে ঘরে ঢুকল। মানসীর পরনে একটা রক্তলাল তাঁতের শাড়ি। সোনালী জরির চওড়া পাড়। হঠাৎ দেখলে মনে হয় যেন মানসীর সর্বাঙ্গে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। অবাক হয়ে সেদিকে চেয়ে থাকে সুকুমার।
কি দেখছ সুকুমার-মানসী বললে!
দাদা কোথায়? বাড়ীতে নেই?
না। শুনলাম এখনও রিজার্ভেশন পাননি! তাই ছোটাছুটি করছেন। বলছিলেন রিজার্ভেশন পেলে গাড়িতেই পুরী যাবেন-গাড়িতেই যদি যাওয়া হয় তো তুমিও চল না।
না।
জান সুকুমার, আমার মন যেন বলছে, তোমার সঙ্গে জীবনে আর আমার দেখা হবে না, আর তুমিও তো তাই চাও—তাই না?
হঠাৎ ঐ কথা তোমার মনে হল কেন মানসী? সুকুমার বললে।
আবার বড় কষ্ট সুকুমার–
কি হয়েছে মানসী? সুকুমার বললে।
তুমি তো জান—আমি অনেক দিন থেকে ডাইরি রাখি। যেদিন আমি থাকব না সেদিন আমার ডাইরিটা তুমি পড়ে দেখ।
নীচে থেকে ঐ সময় শরদিন্দুর গলা শোনা গেল—গোকুল!
শরদিন্দুর গলা শুনেই মানসী বলল, চলি–
তোমার ডাইরিটার কথা কি বলছিলে?
পরে বলব। মানসী আর দাঁড়াল না। ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
০৪. মানসীর সঙ্গে ঐ শেষ দেখা
মানসীর সঙ্গে ঐ শেষ দেখা সুকুমারের। পরের দিনই পুরী এক্সপ্রেসে মানসীকে নিয়ে শরদিন্দু চলে যায়। শরদিন্দু ফিরে এল কিন্তু তার সঙ্গে মানসী ফিরে এল না।
যেদিন শরদিন্দু এসে মানসীর মৃত্যুসংবাদটা সুকুমারকে দিল, সুকুমার প্রথমটায় সত্যিই চমকে উঠেছিল। মানসী পুরীর সমুদ্রে সাঁতার কাটতে গিয়ে তলিয়ে গিয়েছে।
মানসী যে কেবল ভাল সাঁতারই জানত তাই নয়—কলেজে পড়ার সময় সাঁতারে সে বিশেষ পারদর্শিনী ছিল। শরদিন্দুর সেকথা জানবার কথা নয়, কিন্তু সুকুমার জানত। তাই কথাটা শুনে কয়েকটা মুহূর্ত শরদিন্দুর মুখের দিকে কেমন যেন একপ্রকার বিস্ময়েই তাকিয়ে ছিল সুকুমার।
কিন্তু শরদিন্দুর তখনকার চেহারা ও চোখের অসহায় দৃষ্টি—যে দৃষ্টির মধ্যে ছিল সর্বস্ব হারানোর এক ব্যথা—সেটাও সে অবিশ্বাস করতে পারেনি।
কটা দিন শরদিন্দু কোথাও বেরুল না। সর্বক্ষণ বাড়িতেই থাকে।
শেষটায় সুকুমারই বলেছিল, যা হয়ে গিয়েছে তার তো আর কোন চারা নেই। শরদিন্দুদা—তুমি বরং দিনকতক কোথাও গিয়ে ঘুরে এস শরদিন্দুদা।
আচ্ছা সুকুমার, মানসীকে তুই অনেক দিন থেকেই চিনতিস, তাই না?
সুকুমার কথাটা শুনে চমকে ওঠে। কি বলতে চায় শরদিন্দু!
কি রে, আমার কথার জবাব দিচ্ছিস না কেন? জানতিস ওকে অনেক দিন থেকেই, তাই না?
চিনতাম।
তা সেকথা আমাকে বলিসনি কেন? তাহলে তো এত বড় ভুলটা করতাম না আমি!
না, তুমি ভুল করছ। তুমি বিশ্বাস করতে পার আমরা পরস্পরকে বিবাহ করব এমন কোন কথা কখনও আমাদের মধ্যে হয়নি। এখন বুঝতে পারছি, একটা ভুলের মধ্যে পড়ে তুমি নিজেও। দুঃখ পেয়েছমানসীকেও দুঃখ দিয়েছ। তবে ভুল আমিও করেছি, তোমার ঐ ধারণার কথা জানা সত্ত্বেও এ বাড়ি ছেড়ে আমার না চলে যাওয়াটা—অনেক দিন আগেই আমার এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত ছিল—আমি কালই চলে যাব।