সুকুমার—মৃদু গলায় ডাকল মানসী, বিয়েটা কিন্তু আমার ইচ্ছায় ঘটেনি, তাছাড়া—
তোমার ইচ্ছায় ঘটেনি! সুকুমার হাসল।
বাবার অনুরোধ আমি ঠেলতে পারলাম না সুকুমার। বলতে পার ঠেলা আমার পক্ষে সম্ভবও ছিল না।
পারনি বুঝি! আবার সুকুমার হাসল।
না। কিন্তু কাল রাত্রে এ বাড়িতে এসেছি আমি, এর মধ্যে কি একবারও সময় পাওনি তুমি আমার সঙ্গে দেখা করার?
পাব না কেন, কিন্তু তোমাকে আমি বিব্রত করতে চাইনি।
তুমি তাহলে এই বাড়িতেই থাক সুকুমার?
একটু আগে তো বললাম, তবে তোমার যদি কোন রকম অসুবিধা হয় আমি এ বাড়িতে থাকলে—
না না, আমার অসুবিধা হবে কেন?
না, তাই বলছি, অসুবিধা হলে কিন্তু কথাটা বলতে কোন দ্বিধা কোরো না। আমি চলে যাব। আচ্ছা চলি বৌদি-মানসী বলে নয়, সেই প্রথম সুকুমার ওকে বৌদি বলে সম্বোধন করল।
হঠাৎ ঐ সময় দপ করে সারাবাড়ি অন্ধকার হয়ে গেল। ঘন অন্ধকার গ্রাস করল বাড়িটা। উৎকণ্ঠিত গলায় মানসী বললে, এ কি! আলো—
বোধ হয় ফিউজ হয়েছে, ভয় পেয়ো না, আমি দেখছি—
অন্ধকার ঘর থেকে বের হয়েই সুকুমার কার সঙ্গে যেন ধাক্কা খায়।
কে—কে! শরদিন্দুর গলা।
সুকুমার ঐ মুহূর্তে শরদিন্দুর গলা শুনে থমকে যায়, তারপর সাড়া না দিয়ে অন্ধকারে দ্রুত পাশ কাটিয়ে সিঁড়ির দিকে চলে যায়।
শরদিন্দুর গলা শোনা গেল আবার, সুকু—সুকু নাকি রে!
সুকুমার সাড়া না দিয়ে দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে যায়।
পরে অনেকবার ভেবেছে সুকুমার, সেদিন কেন সাড়া দিল না শরদিন্দুর ডাকে সে! অথচ সুকুমার সেদিন ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেনি আলো নিভে যাওয়ার পূর্বমুহূর্তে ঐ ঘরের একেবারে, দরজার গোড়াতেই দাঁড়িয়েছিল শরদিন্দু এবং সুকুমারের শেষ কথাগুলো কানে গিয়েছিল তার।
আলো জ্বলতে সেরাত্রে আরও আধ ঘণ্টাসময় লেগেছিল। সুকুমারই ছুটোছুটি করে মিস্ত্রী ডেকে আবার বাড়ির আলো জ্বালিয়েছিল।
নিমন্ত্রিতদের প্রায় সকলেরই খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল। আলোটা নিভেছিল ঠিক নিমন্ত্রিতরা আহার শেষ করে যখন উঠে পড়েছে, কিন্তু তারা তখনও বিদায় নেয়নি। আলো জ্বেলে ওঠবার পর একে একে তারা বিদায় নেয়।
শরদিন্দু ইতিমধ্যে আবার ওপর থেকে নীচে প্যাণ্ডেলে চলে এসেছিল। শরদিন্দু সুকুমারকে একপাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শুধাল, কোথায় ছিলি রে সুকু?
কেন—আমি তো যেখানে ক্যাটারাররা প্লেট সাজাচ্ছিল সেখানেই ছিলাম।
গোকুল এত খুঁজল কিন্তু তোকে কোথাও দেখতে পেল না তো!
কই! আমি তো কিছু জানি না!
খেয়েছিস?
না, শরদিন্দুদা আমি আজ আর কিছু খাব না।
খাবি না কি রে?
হ্যাঁ। অনেক রাত হয়ে গিয়েছে তাছাড়া শরীরটাও ভাল নেই।
তা তো হবেই, তিন দিন ধরে যে খাটাখাটনি যাচ্ছে, চল, যা পারবি খাবি।
সুকুমারের কোন আপত্তিই শুনল না শরদিন্দু, তাকে নিয়ে দোতলাতে ডাইনিং রুমে গেল। মানসীকে ডেকে নিয়ে এল শরদিন্দু।
তিনজনে খেতে বসল, মাঝখানে মানসী, দুপাশে সুকুমার আর শরদিন্দু। সুকুমার কিছুই খাচ্ছে না। খাবার নিয়ে নাড়াচাড়া করছে ব্যাপারটা শরদিন্দুর দৃষ্টি এড়ায় না। শরদিন্দু বললে, কি রে, তুই যে কিছুই খাচ্ছিস না!
সেই—সেই রাতেই প্রথম সুকুমার শরদিন্দুর দু চোখের দৃষ্টিতে যেন একটা কুটিল সন্দেহের ছায়া দেখতে পেয়েছিল, এবং তার পর যে দেড়টা বছর মানসী বেঁচে ছিল সুকুমার দেখেছে শরদিন্দুর চোখের দৃষ্টিতে একটা সন্দেহ।
অস্বস্তি বোধ করেছে সুকুমার, মনে মনে ভেবেছে ঐ বাড়ি ছেড়ে সে চলে যাবে। কিন্তু পারেনি। একটা অদৃশ্য নাগপাশের বন্ধনে যেন সে বাঁধা পড়েছিল, সে বন্ধনকে ছিড়ে সে কিছুতেই চলে যেতে পারছিল না।
আশ্চর্য একটা পরিবর্তন যেন লক্ষ্য করছিল সুকুমার শরদিন্দুর চরিত্রে। যে মানুষটা কারখানা আর ব্যবসা নিয়ে সর্বক্ষণ ব্যস্ত থাকত, বাড়িতে আসার কোন নির্দিষ্ট সময় ছিল না—সেই মানুষটাই কিছুতেই যেন আর বাড়ি থেকে বের হতে চায় না। কারখানায় গেলেও ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই চলে আসে। সর্বক্ষণ সে মানসীর চারপাশে ঘুরঘুর করে যেন।
মানসী বলে, কারখানায় অফিসে যাবে না?
তোমাকে খুব বিরক্ত করছি, তাই না মানসী? শরদিন্দু বলে—
বিরক্ত—কেন বিরক্ত কেন, তা নয়—লোকে তোমাকে স্ত্রৈণ বলবে!
বলে বলুক। এক কাজ করবে মানসী–তুমিও আমার সঙ্গে অফিসে কারখানায় চল না! ওমা, সে কি!
কেন, ক্ষতি কি? সর্বক্ষণ তোমাকে পাশে পাশে দেখতে পাব?
না, ছি! বিপরীত হয়েছিল কিন্তু সুকুমারের বেলায়। অনেকদিন সকালে সে ব্রেকফাস্ট না করেই কারখানায় চলে যেত, ফিরত সেই রাত দশটা-এগারোটা! সুকুমারকে যেন বাড়িতে দেখাই যেত না।
শরদিন্দুই একদিন সুকুমারকে ব্রেকফাস্ট-টেবিলে বললে, কি রে সুকু, তুই দেখছি হঠাৎ ভীষণ কাজের মানুষ হয়ে গেলি, আগে তো কারখানায় দু-এক ঘণ্টার বেশি থাকতিস না!
সুকুমার আড়চোখে একবার তাকায় শরদিন্দুর দিকে শরদিন্দুর দু-চোখে সেই কুটিল সন্দেহ। সে সন্দেহ যেন আরও প্রখর আরও স্পষ্ট।
কোনমতে চায়ের কাপে চুমুক দিয়েই সুকুমার টেবিল থেকে উঠে পড়ে।
সুকুমার পারতপক্ষে মানসীর সামনেই যেত না। অফিস থেকে ফিরে সে সোজা নিঃশব্দে তিনতলায় নিজের ঘরে চলে যেত।
শরদিন্দুর বিবাহের আগে সুকুমার দোতলাতেই থাকত, বিয়ের পরেই সুকুমার তিনতলার ঘরে আশ্রয় নিয়েছিল। একমাত্র ব্রেকফাস্টের সময় ছাড়া সুকুমার আর কখনও খাবার ঘরে আসত না। তাও নিয়মিত নয়। লাঞ্চ সে দুপুরে অফিসেই করে নিত, রাত্রের আহার গোকুল তিনতলায় তার ঘরে এনে ঢাকা দিয়ে রাখত!