শুনেছ? তা দাঁড়িয়ে রইলে কেন মানসী, বোসো–শরদিন্দু বলল।
না, বসতে আমি আসিনি, কেবল একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে এসেছি—আপনি কি আমার গরিব বাপকে দয়া করছেন?
দয়া! তুমি কি আমার সঙ্গে ঝগড়া করতে এসেছ মানসী?
না। আমি জানতে এসেছি ওটা দয়া নয় তো কি!
না, সত্যিই আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই।
কিন্তু কেন, জানতে পারি কি? আপনি তো একদিন মাত্র কিছুক্ষণের জন্য আমাকে দেখেছেন, আমার সম্পর্কে কিছুই জানেন না। সেক্ষেত্রে হঠাৎ–
তোমার সম্পর্কে কিছু জানার দরকার আছে বলে আমি মনে করি না।
কিন্তু আমি মনে করি আমার সম্পর্কে আপনার জানার প্রয়োজন আছে।
তা যদি বল তাহলে আমিও তো এতদিন ব্যাচিলর হয়ে আছি, আমার সম্পর্কেও তো তোমার জানা প্রয়োজন। শোন, প্রথম পরিচয়েই তোমাকে আমার ভাল লেগেছে, তাই–
তাই বিয়ে করছেন আমাকে?
অবিশ্যি তোমার যদি আপত্তি না থাকে, প্রায় চল্লিশ বছরের একজনকে—
মানসী আর কোন কথা বলতে পারে না।
মানসী, একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?
কি?
তুমি কি কাউকে ভালোবাস?
যদি বাসিই তাহলে নিশ্চয়ই বিবাহের ইচ্ছেটা আপনার আর থাকবে না?
না না, তা কেন, আমি যখন একবার স্থির করেছি তোমায় বিবাহ করব, অবশ্য তোমার আপত্তি থাকলে আবারও বলছি, এ বিয়ে হবে না।
মানসী আবার চুপ।
মানসী, চুপ করে থেকো না। যা বলবার বল। কোন সংকোচ কোরো না।
বাবার কাছে আপনি ব্যাপারটা বলেছেন, বাবার কাছ থেকেই জবাবটা পাবেন। নমস্কার— কথাগুলো বলে মানসী ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
০২. দিন পনেরো পর
দিন পনেরো পর অতঃপর সব ব্যবস্থা হয়ে গেল গোপনে গোপনে।
শরদিন্দু কাউকে ব্যাপারটা জানতে দেয়নি, এমন কি সুকুমারকেও নয়?
বিবাহের দিনতিনেক আগে অফিসে বেরুবার আগে শরদিন্দু সুকুমারকে তার ঘরে ডেকে। পাঠিয়ে কথাটা বললেন।
সুকু, একটা কথা তোকে এখনও জানাইনি, মনে বলা হয়নি। আমি বিয়ে করছি—
সত্যি! সত্যি তুমি বিয়ে করছ দাদা! সুকুমার সত্যিই উৎফুল্ল হয়ে ওঠে।
নিশ্চয়ই তুই সুখী হয়েছিস্?
সুখী মানে, কথাটা যদি সত্য হয় তো আনন্দের আমার সীমা থাকবে না!
কথাটা সত্যি সুকুমার, কিন্তু কই, জিজ্ঞাসা করলি না তো কোথাকার মেয়ে–কার মেয়ে –কেমন মেয়ে
তুমি বিয়ে করছ সেটাই বড় কথা, তুমি কি না জেনেশুনে বিয়ে করছ?
মেয়েটি কে জানিস? পরেশ নন্দী—যিনি আমাদের অ্যাকাউনটেন্ট ছিলেন এবং কিছুদিন হল রিটায়ার করেছেন—তারই মেয়ে, নাম মানসী।
সুকুমার যেন হঠাৎ একেবার চুপ। একেবারে যেন বোবা হয়ে গিয়েছিল।
কি হল, তোর মনঃপূত হল না নাকি?
অ্যাঁ–না না—কেন হবে না—ম্লান হাসি হাসল সুকুমার, খবরটা সত্যিই সুখের আনন্দের। কিন্তু বিয়েটা কবে?
কবে কি রে, পরশু বাদে তরশুই তো!
মানে সামনের বৃহস্পতিবারে? কিন্তু কিছুই তো যোগাড়যন্ত্র নেই–
সে তোকে ভাবতে হবে না। সব ব্যবস্থাই করা হয়ে গিয়েছে।
ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছে। কি বলছ তুমি?
হ্যাঁ, সাত নম্বর বাড়িটা ভাড়া নিয়েছি, আর ডেকরেটার ক্যাটারার সবাইকে অর্ডার দেওয়া হয়েছে তো কবেই। আসলে কি জানিস সুকু, আমার যেন কেমন একটা লজ্জা করছে, তাছাড়া এই বুড়ো বয়সে বিয়ে করছি
তা হোক—খুব ধুমধাম করতে হবে কিন্তু–
রে না, ওসব হাঙ্গামায় কাজ নেই।
শোন দাদা, বিয়ে বলে কথা! ও একবারই হয়, আমি যা করার করব।
সত্যি সুকুমার যেন কোমর বেঁধে লেগে গেল। দুদিনের মধ্যে বাড়িটা আলো দিয়ে সাজিয়ে ফেলল, নহবৎ বসাল—সে এক যেন এলাহি ব্যাপার।
ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে গেল।
কিন্তু বৌভাতের দিন সকাল থেকে সুকুমারের আর পাত্তা নেই। কোথায় গেল সুকুমার–শরদিন্দু ডেকে ডেকে সুকুমারের সাড়া পায় না।
গোকুল ছোট দাদাবাবু কোথায় রে? শরদিন্দু শুধায়।
কেন, একটু আগে তো দেখেছিলাম, ওপরে তার ঘরে। গোকুল বললে।
দেখ তো কোথায়!
কিন্তু গোকুল কোথাও সন্ধান পেল না সুকুমারের।
তখন অনেক রাত। শেষ ব্যাচ খেতে বসেছে। সানাই বাজছে। মানসী বসেছিল ঘরে। ঐ ঘরেই ফুলশয্যা হবে। ফুলে ফুলে ঘরটা যেন ভরে গিয়েছে। ঘরের মধ্যে দ্বিতীয় কোন প্রাণী ছিল না। শরদিন্দু নীচে যেখানে সবাই খেতে বসেছে সেখানে তদারকি করছে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে–
মানসী–
চমকে দরজার দিকে তাকাল মানসী। সুকুমার, তুমি? মানসী বললে।
সুকুমার মৃদু হাসল। খুব অবাক হয়ে গিয়েছ, তাই না?
কিন্তু তুমি এখানে! মানসী বললে।
আমি তো এই বাড়িতেই থাকি। শরদিন্দুদা আমার বড় পিসিমার একমাত্র ছেলে।
সুকুমার—
শোন, একটা কথা বলতে এসেছিলাম—
মানসী চুপ করে থাকে।
আমাদের যে পরস্পরের পরিচয় ছিল তোমাদের বিয়ের আগে, কথাটা যেন শরদিন্দুদা কোন দিন না জানতে পারে। সুকুমার বললে।
কেন? কথাটা বলে তাকাল মানসী সুকুমারের মুখের দিকে।
আমার মনে হয় না জানাই ভাল। তবে এই কথাটা যদি তুমি আমাকে আগে জানাতে, আমি কিন্তু খুশিই হতাম মানসী! সাত দিন আগেও তোমার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল ইডেন গার্ডেনে। তখন তো সবই ঠিক হয়ে গিয়েছিল, তখন তো বললে না কিছু!
মানসী তখনও চুপ করে থাকে।
ভালই করেছ মানসী, আমি তো পর-ভৃত্য, এত ঐশ্বর্য তো তোমাকে আমি দিতে পারতাম। সত্যি তোমাকে কিন্তু চমৎকার মানিয়েছে মানসী এখানে এই ঐশ্বর্যের মধ্যে!
মানসী বলতে পারত, তিন বছর তোমার জন্য অপেক্ষা করেছিলাম সুকুমার, যখনই আমাদের পরস্পরের দেখা হয়েছে, ভেবেছি তুমি বলবে বিয়ের কথাটা, কিন্তু তুমি বলনি। অপেক্ষা করে করে আমি ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু সে সব কিছুই বলল না মানসী।