বাইরে ইতিমধ্যে অনেকক্ষণ দিনের আলো নিভে গিয়েছে। সুব্রত একটা হাই তুলে শয্যার ওপর উঠে বসল। তারপর বেয়ারাকে চায়ের অর্ডার দিয়ে সুব্রত বললে, রাতটা কি এখানেই কাটানো হবে?
একবার বেরুতে হবে—এখন সাতটা বাজে—এই পৌনে আটটা নাগাদ।
কোথায়?
লক্ষ্মীর ভবনে-সেখানে আর একবার যেতে হবে।
জগন্নাথ সাহুর ঐ কাঠ-কাঠ কথা বলবার পরও?
সে কাঠ থেকেই রস বার করতে হবে সুব্রত!
বাবা, আমি আর সেখানে যাচ্ছিনে।
কেন, গলাধাক্কার ভয়ে নাকি? কিরীটী মৃদু হেসে বললে।
রসিকতা থাক। সত্যিই আবার সেখানে যাবে নাকি?
বাঃ, এতদূর এসে শ্রীমতী লক্ষ্মী দেবী—মানে আমাদের মানসী দেবীর সঙ্গে না দেখা করেই চলে যাব?
তা দেখাটা করবে কেমন করে?
ইচ্ছা থাকলেই উপায় হয়!
১৩. জগন্নাথ সাহুর বাড়ির কাছে
জগন্নাথ সাহুর বাড়ির কাছে ওরা যখন পৌছাল তখন জানালাটা বেশ অন্ধকার, লাইটপোস্টটা অনেকটা দূরে—অত দূর পর্যাপ্ত আলোটা পৌঁছয় না, তাই কেমন যেন একটা আলোছায়ার ছমছমানি। হঠাৎ পিছন দিক থেকে একটা মৃদু পদশব্দ কানে আসতেই কিরীটী একপাশে সরে দাঁড়িয়ে সুব্রতর হাত ধরে আকর্ষণ করল।
কি ব্যাপার?
চুপ, ঐ দেখ—কে যেন এই দিকেই আসছে!
সুব্রত দেখল অবগুণ্ঠনবতী এক নারী একটু যেন দ্রুত পদেই ঐদিকে আসছে। অবগুণ্ঠনবতী সামনাসামনি আসতেই কিরীটী মৃদুকণ্ঠে ডাকল, শুনছেন!
অবগুণ্ঠনবতী না দাঁড়িয়ে আরও জোরে গতি বাড়িয়ে দেয়। কিরীটী দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে বলে, শুনুন, দাঁড়ান মানসী দেবী!
হঠাৎ যেন থমকে দাঁড়াল এবার অগ্রবর্তিনী।
মানসী দেবী, আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে—এই শহরে সবচেয়ে বড় যে হোটেলটা, সেই হোটলেরই দোতলায় যোল নম্বর ঘরে উঠেছি আমি। আমার নাম কিরীটী রায়—আপনার জন্য আমি অপেক্ষা করব।
নারীমূর্তির দিক থেকে কোন সাড়াশব্দ এল না।
আমি জানি সমুদ্রের জলে আপনার মৃত্যু হয়নি, আপনি বেঁচে আছেন। যাক, আমি কিন্তু অপেক্ষা করব হোটেলে আমার ঘরে। এস সুব্রত!
কিরীটী আর দাঁড়াল না। হনহন করে এগিয়ে গেল।
কিরীটী চেয়ারে চুপচাপ বসে একমনে পাইপ টানছে। সুব্রত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, রাত এগারোটা বেজে দশ মিনিট।
তোমার ধারণা, সত্যিই তিনি আসবেন? সুব্রত বললে।
কিরীটী কোন কথা বলল না, অন্যমনস্ক ভাবে জানালার ওপাশে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইল।
আমার মনে হয়—
কিরীটী সুব্রতকে তার কথা শেষ করতে দিল না, বললে, মানসী যদি না—
কিন্তু কিরীটীর কথা শেষ হল না, ওদের ঘরের বদ্ধ দরজার গায়ে মৃদু টোকা শোনা গেল। সঙ্গে সঙ্গে কিরীটী উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিল। দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে অবগুণ্ঠনবতী এক নারী।
আসুন—আসুন মানসী দেবী।
আগন্তুক কমধ্যে প্রবেশ করল। কিরীটী দরজাটা আবার বন্ধ করে দিল। গুণ্ঠন মোচন করল অবগুণ্ঠনবতী। স্থির দৃষ্টিতে তাকাল কিরীটী মুখের দিকে।
বসুন, দাঁড়িয়ে কেন?
আপনি আমাকে চেনেন? মানসী প্রশ্ন করল।
কিরীটী একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল মানসীর মুখের দিকে। মনে মনে সে মানসীর ফটোর সঙ্গে ওর চেহারাটা মিলিয়ে নিচ্ছিল।
চিনি বললে যেমন সবটা বলা হবে না, তেমনি চিনি না বললেও সত্যের অপলাপ করা হবে মানসী দেবী। আপনার সঙ্গে পূর্বে সাক্ষাৎ পরিচয় না হলেও আপনার ফটোর সঙ্গে আমার পরিচয় আছে!
আমার ফটো? আমার ফটো কোথায় পেলেন আপনি?
আপনার বাবা পরেশবাবুর কাছ থেকে। আপনার বাবা বিশ্বাস করেননি যে জলে ড়ুবে আপনার মৃত্যু হয়েছে। তাই তিনি আপনার সন্ধানে আমাকে নিযুক্ত করেছেন। কিন্তু আপনি দাঁড়িয়ে রইলেন কেন, বসুন!
সত্যিই আমি মরিনি সেদিন কিরীটীবাবু, বসতে বসতে বলল মানসী।
আমিও তাই বিশ্বাস করেছিলাম।
কিন্তু কেন আপনি বিশ্বাস করেছিলেন, আমি সাঁতার জানতাম বলে?
কিছুটা তাই বটে, তবে আরও কারণ ছিল, আমি অবিশ্যি জিজ্ঞাসা করব না সেদিন কেমন করে আপনি রক্ষা পেয়েছিলেন।
আপনি হয়তো একটা কথা জানেন না কিরীটীবাবু, আমাকে সেদিন হত্যা করবারই চেষ্টা করা হয়েছিল।
তাও আমি অনুমান করেছিলাম, কিরীটী বলল।
জানেন, সরবতের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে আমাকে হত্যা করবার চেষ্টা হয়েছিল।
বিষ?
হ্যাঁ, কিন্তু নোনা জল কিছু পেটে ঢাকায় বমি করে ফেলি জলের মধ্যে, আমার বিষের ক্রিয়াও একটু একটু করে কেটে যায়। এবং কথাটা বুঝতে পারার সঙ্গে সঙ্গেই আমি সাঁতরে তাদের নাগালের বাইরে চলে যাই। কারণ আমি বুঝতে পেরেছিলাম নাগালের বাইরে না চলে গেলে আবার আমাকে হত্যা করবার চেষ্টা করা হবে।
কার কথা বলছেন?
কার কথা বলব বুঝতে পারছি না, কারণ, আমি দুজনকে সন্দেহ করি—
আপনার স্বামী শরদিন্দুবাবু আর সুকুমারবাবুকে? কিন্তু সেসময় তো সুকুমারবাবু বাড়িতে উপস্থিত ছিলেন, যতদূর জানি।
ছিল সে—তাকে ঐ ঘটনার আগের দিন আমি সী বীচে দেখেছিলাম।
আপনার স্বামী জানতে পেরেছিলেন?
সম্ভবত না।
আপনি তাকে কিছু বলেননি?
না। কারণ বুঝেছিলাম যে পুরীতে এসেও সুকুমার যখন আমাদের সঙ্গে দেখা করেনি তখন কথাটা গোপন রাখতে চায়।
সেদিন যা ঘটেছিল আমাকে বলবেন?
আমার স্বামী মানসী বলতে লাগল, বিবাহের পর থেকেই সুকুমারকে নিয়ে আমাকে সন্দেহ করত—
আমি জানি।
জানেন?
হ্যাঁ, আপনার ডাইরি পড়েই জেনেছি।
আমার ডাইরি আপনি কোথায় পেলেন?
আপনার বাবা আমায় দিয়েছেন।
জানেন কিরীটীবাবু, পুরীতে একটা কিছু ঘটবে এই আশঙ্কা করেই আমি ডাইরিটা আমাদের বাড়িতে রেখে এসেছিলাম–যাতে সেটা আমার আকস্মিক মৃত্যু ঘটলে এদের মানে স্বামী ও সুকুমারের হাতে না পড়ে।