মিসেস ভট্টাচার্য ঐ সময় কিচেনের দিকে উঠে গেলেন এবং বলে গেলেন, বোসো, আমি কফির কথা বলে আসি।
ঘরের মধ্যে কিরীটী আর উদয়। কি আশ্চর্য রকমের মিল মানসীর মুখের সঙ্গে!
কিরীটী কিন্তু তার মনের বিস্ময় প্রকাশ করল না। কেবল উদয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, মেয়েটির নাম কি উদয়বাবু?
লক্ষ্মী।
পদবী কি?
তা তো জানি না!
এখানকারই মেয়ে? মানে এই শহরেই থাকেন?
না, ভুবনেশ্বরে থাকেন শুনেছি।
বিবাহিত কি মেয়েটি?
বিবাহিত নন বলেই শুনেছি আর সিঁথিতে সিঁদুর দেখিনি।
আচ্ছা উদয়বাবু মেয়েটির সঙ্গে একবার দেখা করা যায়?
মেয়েটি অত্যন্ত রিজার্ভড় প্রকৃতির। কারও সঙ্গেই বড় একটা কথা বলেন না।
মেয়েটি সম্পর্কে আপনি আর কিছু জানেন উদয়বাবু?
নীলমণি-মানে আমাদের ডিরেক্টরের কাগজে একটা বিজ্ঞাপন দেখে অ্যাপ্লাই করেছিল, নীলমণি ওঁকে ডেকে পাঠায়—আমিও সেদিন নীলমণির অফিসে উপস্থিত ছিলাম, নীলমণির পছন্দ হয়ে যায় মেয়েটিকে—ওঁর ক্যামেরা টেস্ট ভয়েস টেস্ট নিয়ে নীলমণির ভাল লাগে—সে কন্ট্রাক্ট সই করায়, নীলমণির মুখেই শুনেছি মেয়েটি ভুবনেশ্বরের কোথায় যেন থাকেন।
আপনাদের আবার শুটিং কবে উদয়বাবু?
দশ দিন একটানা শুটিং হয়ে গেল এই তো গত পরশু, আবার শুটিং দিন দশেক পরে।
লোকেশন কোথায়?
পুরীর সমুদ্রের আশেপাশে শুটিং হবে শুনেছি—আউটডোর, এই ছবির বারো আনা অংশই প্রায় আউটডোরে।
কথাটা তাহলে আপনাকে খুলেই বলি উদয়বাবু—কিরীটী বললে, আমার এক বন্ধু আসছে এখানে দুই-তিন দিনের মধ্যে। সে একটা চিত্র পরিচালনা করছে, স্ক্রিপ্ট রেডি, নায়কও ঠিক হয়ে গিয়েছে। এখন সে নায়িকার জন্যে সন্ধান করছে নতুন মুখ। আপনাদের বইয়ের ঐ। মেয়েটির ছবি দেখে মনে হচ্ছে হয়তো তার মেয়েটিকে পছন্দ হয়ে যেতে পারে।
ঠিক আছে, আমি নীলমণিকে বলব। সে নিশ্চয়ই লক্ষ্মীর ঠিকানা জানে।
বলবেন অনুগ্রহ করে। আর মেয়েটির সঙ্গে যদি একটিবার আমার বন্ধুর দেখা হয়ে যায়, তবে খুব ভাল হয়।
নিশ্চয়ই বলব, আমি কালই সকালে এসে আপনাকে জানিয়ে যাব।
সেই রাত্রেই কিরীটী ট্রাঙ্ককলে সুব্রতর সঙ্গে কলকাতায় কথা বলল।
সুব্রত, আমি পুরী থেকে কিরীটী বলছি।
কি ব্যাপার বল তো? সুব্রতর প্রশ্ন?
এখানে এলেই সব জানতে পারবে। গণেশবাবু—আমাদের গণেশ ঘোষকে চেনো তো, রেলে কাজ করেন, তাকে ধরলেই একটা রিজার্ভেশন পেয়ে যাবে। কালই চলে এস।
ঠিক আছে।
কিরীটী রিসিভারটা নামিয়ে রাখল।
পরের দিন সকালবেলা দশটা নাগাদ উদয়বাবু এলেন।
বললেন, সরি কিরীটীবাবু, লক্ষ্মীদেবী ভুবনেশ্বরে নেই!
নেই?
না, নীলমণি বললে তিনি নাকি কলকাতায় গিয়েছেন, ফিরবেন সেই শুটিংয়ের আগের দিন। গতকালই নাকি তিনি নীলমণিকে ফোনে জানিয়েছেন।
ঠিক আছে, আমার চিত্র পরিচালক বন্ধুকে কথাটা জানিয়ে দেব। আর একটা কথা আপনাকে জানিয়ে দিই উদয়বাবু, আপনার কথাও গতরাত্রে আমার বন্ধুকে জানিয়েছি, আপনার সম্পর্কেও সে ইন্টারেস্টেড!
সত্যি? উদয়বাবু সংবাদটায় উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন।
হ্যাঁ, আমার বন্ধুটি সবই নতুন মুখ খুঁজছেন।
কিরীটী উদয়বাবুর দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে সে ঠিকই টোপ ফেলেছে।
উদয়বাবুর কাছে গতকালই ফটোটা দেখার পর থেকে কিরীটী ফটোর মেয়েটার কথাই ভেবেছে। কেন যেন তার ধারণা হয়েছে ফটোর লক্ষ্মী আর মানসী অভিন্ন। অবিশ্যি এও তার মনে হয়েছে, লক্ষ্মী একান্তই যদি মানসী না হয়, কেবলমাত্র আশ্চর্য রকমের একটা মিল উভয়ের মধ্যে—তাহলেও তার কার্যসিদ্ধি হয়ে যাবে। নতুন একটা প্ল্যান তার মাথায় এসেছে।
ঐদিনই রাত্রে, রাত্রি তখন সোয়া এগারোটা হবে। হোটেলের সকলের খাওয়াদাওয়া চুকে গিয়েছে প্রায়। ঘরে ঘরে আলো নিভে গিয়েছে। কিরীটী তার ঘরে বসে একটা উপন্যাস পড়ছিল, বন্ধ দরজায় গায়ে মৃদু টোকা পড়ল। কিরীটী উঠে দরজা খুলে দিল। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সুষমা ভট্টাচার্য।
মিসেস ভট্টাচার্য, আসুন!
কথা আছে–মিসেস ভট্টাচার্য ভিতরে ঢুকে বললেন।
বসুন–বলে কিরীটী ঘরের দরজার ভিতর থেকে খিল তুলে দিল।
কাল আপনাকে একটা কথা বলিনি কিরীটীবাবু। মিসেস ভট্টাচার্য বললেন, উদয়বাবুদের কলঙ্ক ছবিতে যে নতুন মেয়েটি অভিনয় করছে—মানে উদয়বাবু যে ফটোটা দেখালেন সেই ফটোর চেহারার সঙ্গে শরদিন্দুবাবু যে ফটোটা দিয়েছেন তার একটা আশ্চর্য রকমের মিল আছে চেহারায়–
লক্ষ্য করেছি। কিরীটী বললে, কিন্তু একটা কথা মিসেস ভট্টাচার্য, শরদিন্দুবাবুকে কি আপনি ঐ মেয়েটির কথা বলেছেন?
না—তবে ভাবছি বলব!
না, বলবেন না। আমাদের অনুমান শেষ পর্যন্ত যদি মিথ্যেই প্রমাণিত হয় ভদ্রলোক মনে অত্যন্ত আঘাত পাবেন। তার চেয়ে আগে আমি ভদ্রমহিলার সঙ্গে দেখা করি কথাবার্তা বলি, তারপর–
আচ্ছা আপনার কি মনে হয় কিরীটীবাবু, মানসী দেবীর সেদিন ঐভাবে অদৃশ্য হয়ে যাবার পিছনে কারও কোন অদৃশ্য হাত ছিল?
ছিলই যে তা বলব না? তবে থাকলেও আশ্চর্য হবার কিছু নেই।
তবে কি মিসেস ভট্টাচার্য কিছুক্ষণ কিরীটীর মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে বললেন, সেদিন মানসী দেবীকে হত্যা করবার চেষ্টা করা হয়েছিল।
সেটা এখনই সঠিক ভাবে বলা যাচ্ছে না বলে কিরীটী কথাটা এড়িয়ে গেল।
আরও কিছুক্ষণ পরে মিসেস ভট্টাচার্য বিদায় নিলেন কিরীটীর কাছ থেকে।
১১. সুব্রত পুরীতে এসে পৌঁছাল
সুব্রত পুরীতে এসে পৌঁছাল পরের দিন। কিরীটী স্টেশনে গিয়েছিল।