কাল রাত্রে হঠাৎ—তা রাত তখন প্রায় বারোটা হবে, আমার ঘরের দরজায় টোকা দেওয়ার শব্দ শুনে দরজা খুলে দেখি উনি বললেন, আমাকে চিনতে পারছেন মিসেস ভট্টাচার্য?
বললাম, আপনাকে সেই দিনই চিনেছি, যেদিন আপনি এই হোটেলে এসে ওঠেন। তখন আমার কিছু কথা আছে আপনার সঙ্গে বলে উনি আমার ঘরে এসে ঢুকলেন। এবং বললেন, আমি যে কারণে এবারে এখানে এসেছি সে কথাটা গোপন রাখতে চাই এবং যাতে জানাজানি না হয় সেই কারণেই আপনার সঙ্গে এত রাত্রে দেখা করতে এসেছি। মিসেস ভট্টাচার্য, আপনার হয়ত মনে আছে বছর দুই পূর্বে আমি আমার স্ত্রীকে নিয়ে এখানে বেড়াতে এসে এই হোটেলেই কুড়ি নম্বর ঘরে উঠেছিলাম—এখানে আসার পাঁচ দিন পরে বিকেলের দিকে সমুদ্রে স্নান করতে গিয়ে আমার স্ত্রী জলে ড়ুবে যান—আমি বললাম, মনে আছে। তখন উনি বললেন, আপনি হয়তো জানেন না আমার স্ত্রী খুব ভাল সাঁতার জানত, তাই প্রথম থেকেই কেন যেন আমার ধারণা হয়েছিল যে, সে হয়তো জলে ড়ুবে যায়নি, আমি সেই কারণে সারাটা রাত ও পরের দিন সমুদ্রের ধারে ধারে তার অনুসন্ধান করি কিন্তু কোন সন্ধান পেলাম না, তখন পুলিসে ডাইরি করি।
উনি আর কি বলেছেন? কিরীটী শুধাল।
বললেন, যেটা আমার মনের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব জাগিয়েছিল সেদিন, পরে সেটাই একটা বদ্ধমূল ধারণায় পরিণত হয়েছে। মনে হয় সে আজও বেঁচে আছে—তাই আর একবার ব্যাপারটা ভাল করে অনুসন্ধান করবার জন্যই গোপনে আর একবার পুরীতে এসেছি। কিন্তু জায়গাটার সঙ্গে তো আমার বিশেষ তেমন একটা পরিচয় নেই, আপনারা দীর্ঘদিন এখানে আছেন—তাই মনে হল এ ব্যাপারে আপনি হয়তো আমাকে কিছু সাহায্য করতে পারেন।
আমি বললাম, আমি কি ভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি মিঃ বোস?
মিঃ বোস বললেন, বাইরে থেকে এখানে আপনার হোটেলে এসে যারা থাকেন তাঁরা নন—এখানকার যেসব স্থানীয় লোক মধ্যে মধ্যে আপনার হোটেলে আসেন, তাঁদের সঙ্গে আপনার নিশ্চয় পরিচয় আছে তাদের কাছ থেকে আপনি যদি জানতে পারেন এই ফটোর সঙ্গে মিল আছে এমন কোন স্ত্রীলোককে তাঁরা দেখেছেন কিনা-বলে পকেট থেকে তার স্ত্রীর একটা ফটো বের করে আমাকে দেন।
ফটোটা আছে আপনার কাছে? কিরীটী প্রশ্ন করল।
হ্যাঁ, এই যে দেখুন না-বলে মিসেস ভট্টাচার্য ড্রয়ার থেকে একটা ফটো বের করে কিরীটীর সামনে রাখল।
কিরীটী দেখল, ফটোটা মানসীরই ফটো। পরেশ নন্দী তাকে যে ফটোটা দিয়েছেন তার সঙ্গে হুবহু মিল আছে চেহারার।
আপনি আপনার এখানকার পরিচিত কাউকে ফটোটা দেখিয়েছেন?
না, এখনও সেরকম কেউ আসেননি বলে দেখাইনি। তবে আজ অবিনাশবাবুর আসার কথা আছে—আজ তো শনিবার—শনিবার শনিবার উনি সন্ধ্যার পর আমার সঙ্গে গল্প করতে হোটেলে আসেন।
কিরীটী বুঝতে পারে—অবিনাশবাবু হয়তো কোন এক সময় সুষমা ভট্টাচার্যর একজন গুণমুগ্ধ ছিলেন, তার রূপের পূজারী ছিলেন।
অবিনাশবাবু কি করেন?
এখানে মন্দিরের কাছে বাজারে তার বড় একটা কাপড়ের দোকান আছে। অবিনাশবাবু ছাড়াও আর একজনকে জিজ্ঞাসা করব ভেবেছিলাম।
সে কে?
উদয়—একজন মস্ত বড় সিনেমা আর্টিস্ট। ওড়িয়া ছবিতে অভিনয় করে। তার অনেক গুণমুগ্ধও আছে।
বয়স কত ভদ্রলোকের? কিরীটী প্রশ্ন করল।
চল্লিশ বিয়াল্লিশ হবে। বললেন মিসেস ভট্টাচার্য।
আপনার সঙ্গে তার কত দিনের আলাপ?
তা আজ প্রায় কুড়ি-বাইশ বছর তো হবেই-মিসেস ভট্টাচার্য বললেন।
কিরীটী বুঝতে পারে, উদয়ও হয়তো একদিন সুষমার গুণমুগ্ধদের একজন ছিল। এবং আজও সেই টানেই সুষমার কাছে হয়তো আসা-যাওয়া করে।
ঐ সময় একজন সুদর্শন ভদ্রলোক এসে ঘরে ঢুকলেন, হাতে তার একটা খাম।
বৌদি!
আরে এস এস উদয়বাবু—সুষমা ভট্টাচার্য সানন্দ সম্ভাষণ জানালেন।
কিরীটী তাকাল আগন্তুকের দিকে। মধ্যবয়সী ভদ্রলোক। সুগঠিত দেহ, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ কোঁকড়া চুল সযত্ন-বিন্যস্ত। কিন্তু তার মধ্যে দু-একটা রূপালী চুল যেন চোখে পড়ে। চোখে শৌখীন সোনার-ফ্রেমের চশমা! পরনে দামী ট্রাউজার ও টেরিলিনের হাওয়াই শার্ট!
অনেক দিন পরে এলে উদয়বাবু-বৌদিকে ভুলে গিয়েছিলে বুঝি? মিসেস সুষমা ভট্টাচার্যর মৃদু অভিযোগ।
না না, তা নয় বৌদি, একটা ছবির শুটিং করতে কয়েক দিনের জন্য কোণারক গিয়েছিলাম। কিন্তু একে তো চিনলাম না বৌদি! বেড়াতে এসেছেন বুঝি?
তাই। বিখ্যাত লোক, নাম শুনে থাকবে হয়তো–কিরীটী রায়।
সত্যসন্ধানী কিরীটী রায়! উদয়বাবুর চোখে-মুখে একটা বিস্ময় ঝলসে ওঠে মুহূর্তে। কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল উদয়, আপনার নামই এতকাল শুনে এসেছি কিরীটীবাবু চাক্ষুষ এই প্রথম দেখলাম আপনাকে! কিরীটী মৃদু হাসল। কি বইয়ের শুটিং ছিল উদয়? মিসেস ভট্টাচার্য শুধালেন।
কলঙ্ক। জান বৌদি, সেই যে নতুন মেয়েটির কথা বলেছিলাম-কলঙ্ক ছবিতে সেকেন্ড হিরোয়িনের পার্ট করছেন। যদিও বাঙালী কিন্তু চমৎকার ওড়িয়া বলেন।
কথা বললে এবার কিরীটী, বাঙালী মেয়ে ওড়িয়া ছবিতে অভিনয় করছেন?
হ্যাঁ, আর এই তার প্রথম বই। চমৎকার ফটোজেনিক ফেস। আর অভিনয়ও করছেন চমৎকার। এই যে দেখুন না, গোটাকয়েক কপি আছে আমার সঙ্গে-বলে খাম থেকে গোটাতিনেক স্টীল বের করে সামনে এগিয়ে দিল উদয়।
কোণারকের সূর্যমন্দিরের এক অংশে হেলান দিয়ে মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে। ছবিটার দিকে তাকিয়ে কিরীটীর চোখের পাতা পড়ে না।