ভট্টাচার্য একটু থেমে বলতে লাগলেন, কেমন একটা নেশা ধরে গেল আমার। তারপর আরও দুরাত বন্ধ দরজায় কান পেতে ওদের কথা শুনেছি।
গ্লাসটা নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল, নিবারণ ভট্টাচার্য আবার বোতল থেকে গ্লাসে ঢালতে গিয়ে দেখলেন, বোতলটা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। বললেন, যাঃ, এর মধ্যেই ফুরিয়ে গেল!
কিরীটী বললে, আমার কাছে আছে, তবে বিলেতী—
বিলেতী আঃ, কত দিন খাই না! কোথায় আছে স্যার?
আপনি বসুন, আমি আনছি।
কিরীটী তার ঘরে গিয়ে একটা VAT 69-এর বোতল নিয়ে এল।
বোতলটা হাতে করে নিবারণ ভট্টাচার্য বললেন, স্যার দেখছি একজন রসিক ব্যক্তি, এ সবও চলে।
কিরীটী মৃদু হাসল।
বোতল থেকে খানিকটা গ্লাসে ঢেলে একটা দীর্ঘ চুমুক দিয়ে ভট্টাচার্য বললেন, আঃ, একটা যুগ পরে তারপরই একটু থেমে বললে, কি জানেন মিঃ রায়, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যদি একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং না থাকে সে দাম্পত্য জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। এই নিজেকে দিয়েই তো বুঝতে পারি, একান্ত অনাবশ্যক আজ আমি সুষমার জীবনে—আমি এতটুকু বিস্ময় বোধ করব না ও যদি একদিন বিষপ্রয়োগে আমায় হত্যা করে।
না না, এ কি বলছেন? কিরীটী বললে।
আমার কি মনে হয় জানেন মিঃ রায়, ঐভাবে মিসেস বসুর মৃত্যু হওয়ায় মিঃ বসু মনে মনে খুশিই হয়েছিলেন—নতুবা পরের দিনই সমুদ্রের ধারে বসে কেউ গান গাইতে পারে? আর আমি কাল রাত্রে তাই বলছিলাম ওকে–
কাকে বলছিলেন?
কেন, মিঃ বসুকে, সেই মেয়েটির স্বামীকে!
সেই মেয়েটির স্বামীকে! গতকাল!
হ্যাঁ, তিনি তো এখন এই হোটলেই আছেন। আমার স্ত্রী তাকে চিনতে না পারলেও আমি কিন্তু তাকে দেখামাত্রই চিনতে পেরেছি। আর কি আশ্চর্য জানেন, তিনি আগেরবারের মত সেই বিশ নম্বর ঘরেই এবারেও উঠেছেন। আপনি কোন্ ঘরে আছেন মিঃ রায়?
চোদ্দ নং ঘরে—
তাহলে তো মিসেসের দুখানা ঘরের পরেই—
কি রকম?
১৫, ১৬, ১৭ নম্বরের কোন ঘর নেই—আগে অবিশ্যি আলাদা আলাদা তিনটি ঘর ছিল, এখন ঐ তিনটে কামরায় পার্টিশন তুলে দিয়ে দুটো ঘর করে মিসেস থাকেন।
আর আপনি এইখানে থাকেন?
হ্যাঁ। প্রত্যেক রাত্রে যে ওর তরুণ বন্ধুরা ওকে সঙ্গদান করতে আসে, সব জানি স্যার সব জানি। সবাই জানে আমাকে মোদো মাতাল-কিন্তু সব বুঝি, সব টের পাই আমি। জানেন, সেবারে যখন উনি এসেছিলেন, ওঁর স্ত্রীর মৃত্যুর পরও দুটো দিন এখানে এই হোটেলে ছিলেন উনি, সে সময় ওঁকেও এক রাত্রে মিসেসের ঘরে যেতে দেখেছি।
সে কি! কিরীটী যেন বিস্ময়ে হতবাক।
জানেন এককালে এই হোটেলে অনেকেই এসে উঠত, কেন জানেন—ঐ সুষমার জন্য। আজই না হয় মুটিয়ে গিয়েছে সুষমা, বয়স হয়েছে, কিন্তু দশ বছর আগে খুব সেক্সি ছিল দেখতে এবং আমার টাকার সাহায্য গোড়ার দিকে নিলেও সুষমা তার সেক্সকেই আসল মূলধন করেছিল এবং ক্রমশ আজ যা দেখছেন এই হোটেল—সেই রূপটি পরিগ্রহ করেছে, ফলাও ব্যবসা হয়ে উঠেছে।
কিরীটী বুঝতে পারছিল যে নেশার ঝোঁকে আজ এই মুহূর্তে মনের মধ্যে এতদিনকার চাপা দুঃখটা প্রকাশ করে চলেছেন নিবারণ ভট্টাচার্য। কিরীটী তাই কোন রকম বাধা দেয় না, নিঃশব্দে শুনে চলে। নিবারণ ভট্টাচার্যের গলাটা যেন ধরা ধরা। মনে হয় লোকটা যেন কাঁদছেন।
আমার কি দুঃখ জানেন মিঃ রায় একদিন ছিল যেটা তার প্রয়োজনের মূলধন, এখন প্রয়োজন মিটে যাবার পর হয়েছে একটা অভ্যাস। জানেন মিঃ রায়, আমি নিঃসঙ্গ একাকী সত্যিই, কিন্তু সুষমা আমার চাইতেও নিঃসঙ্গ একাকী। অনেক টাকা আজ ওর, কিন্তু মনের তৃপ্তি ওর নেই।
কথায় কথায় কখন যে রাত শেষ হয়ে এসেছিল। কিরীটী উঠে দাঁড়াল এবং ঘর থেকে বের হয়ে এল। নিবারণ ভট্টাচার্য তখন বোতলটা অর্ধেক করে এনেছেন। দোতলায় উঠে থমকে দাঁড়াল কিরীটী। মিসেস ভট্টাচার্যের ঘর থেকে একজন বের হয়ে এল।
১০. মিসেস ভট্টাচার্য তার অফিস কামরায়
দুপুরে মিসেস ভট্টাচার্য তার অফিস কামরায় একা একা বসে যখন হোটেলের হিসাবনিকাশ করছিলেন কিরীটী এসে অফিস ঘরে ঢুকল।
মিসেস ভট্টাচার্য।
মিঃ রায়? আসুন আসুন, বসুন।
কিরীটী একটা চেয়ার টেনে নিয়ে মিসেস ভট্টাচার্যের মুখখামুখি বসল।
মিসেস ভট্টাচার্য, কুড়ি নম্বর ঘরে কে ভদ্রলোক আছেন বলুন তো?
কেন বলুন তো? মিসেস ভট্টাচার্য সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালেন কিরীটীর মুখের দিকে।
উনি কি শরদিন্দু বোস?
আপনি ওঁকে চেনেন নাকি?
না, ঠিক চিনি না ওঁকে, তবে অনুমান করছি। উনি কাল রাত্রে আপনার ঘরে গিয়েছিলেন?
আপনি কি করে জানলেন?
জেনেছি। আপনার যদি বিশেষ কোন আপত্তি না থাকে তো যদি বলেন—কেন কাল রাত্রে উনি আপনার ঘরে গিয়েছিলেন?
না না, আপত্তি কি থাকতে পারে, ওঁর ধারণা, সেবারে জলে ড়ুবে ওঁর স্ত্রীর মৃত্যু হয়নি, তাই আর একবার ভাল করে ব্যাপারটা অনুসন্ধান করার জন্যই এখানে এসেছেন উনি, আর আমার সাহায্য চান বলেছিলেন, সেই ব্যাপারেই।
উনি এই দুই বৎসরের মধ্যে আর এসেছিলেন এখানে?
এলেও আমি জানি না। আমার এখানে ওঠেননি।
তা হঠাৎ দুবছর পরে তার মনের মধ্যে সন্দেহটা দেখা দিল কেন—কিছু বলেননি আপনাকে?
না, সে-সব কিছু বলেননি।
আপনি কি একটা কথা জানেন মিসেস ভট্টাচার্য, প্রথমা স্ত্রীর জলে ড়ুবে মৃত্যু হবার কয়েক মাস পরেই উনি দ্বিতীয়বার বিবাহ করেছিলেন?
তাই নাকি! না, জানি না তো!
হ্যাঁ, আর সে স্ত্রীরও সমুদ্রে ড়ুবে মৃত্যু হয়েছে একই ভাবে। কাজেই এ থেকে কি সহজেই মনে হয় না, প্রথমা স্ত্রীর মৃত্যুর কথাটা একেবারেই তিনি ভুলে গিয়েছিলেন, এমন কি দ্বিতীয়া স্ত্রীর জলে ড়ুবে মৃত্যুর পর যে কথাটা এতদিন তার মনে হয়নি, আজ হঠাই বা সে কথাটা তার মনে হল কেন? তবে কি মৃতদেহটা পাওয়া যায়নি বলে তার হঠাৎ ধারণা হয়েছে যে তাঁর প্রথমা স্ত্রীর জলে ড়ুবে মৃত্যু হয়নি? এবং সেটাই ভাল করে অনুসন্ধান করবার জন্য আবার এতদিন পরে পুরীতে ছুটে এসেছেন? কিরীটীর শেষের কথাগুলো কতকটা যেন নিম্নকণ্ঠে স্বগতোক্তির মত শোনাল।