তা তিনি যে ঐ ভদ্রলোকই আপনার স্বামী বুঝলেন কি করে?
আমার স্বামী গান শুনে এগিয়ে গিয়ে ডাকেন, মিঃ বোস! উনি আমার স্বামীর ডাকে নাকি সাড়াও দিয়েছিলেন। স্বামীর মুখে পরের দিন সব কথা শুনে আমার যেন কেমন একটু আশ্চর্য বোধ হয়েছিল মিঃ, রায়।
আচ্ছা, আপনার স্বামীর সঙ্গে আর কোন কথা হয়েছিল মিঃ বোসের সেরাত্রে?
জানি না। বলতে পারব না। কারণ আমি কোন বিশেষ কৌতূহল প্রকাশ করিনি সেদিন স্বামীর কথায়, ভুলেও গিয়েছিলাম কথাটা। আজ আপনার কথা শুনে হঠাৎ কথাটা মনে পড়ল।
আপনার স্বামীর সঙ্গে কি কথা বলতে পারি?
কেন পারবেন না, সে তো এখন হোটেলেরই একতলায় তার ঘরে বসে বসে ড্রিঙ্ক করছে, চলুন না, যাবেন তো–
চলুন। কিরীটী উঠে দাঁড়াল।
কিরীটীকে সঙ্গে নিয়ে হোটেলের একতলার একেবারে কোণের দিকের একটা ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালেন মিসেস ভট্টাচর্য। দরজাটা ভেজানো ছিল। কোন সাড়াশব্দ না দিয়েই মিসেস ভট্টাচার্য ভেজানো দরজা ঠেলে কিরীটীকে নিয়ে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলেন।
কিরীটীর নজরে পড়ল ঘরের আলোয়—পরনে একটা মিলিটারীর রং জ্বলে যাওয়া বটলগ্রীন প্যান্ট ও গায়ে একটা গেঞ্জি, বছর ষাট-বাষট্টির একটা লোক চেয়ারে বসে গুনগুন করে একটা ইংরেজি গানের সুর ভাঁজছে! চ্যাপটা লম্বা চেহারা, অনেকটা ঝাকাসের মত শীর্ণ। গাল দুটো– ভাঙা, মুখে খোঁচা খোঁচা কাঁচাপাকা দাড়ি, মাথায় ঝাকড়া ঝাঁকড়া বিশৃঙ্খল চুল। সামনের টেবিলে একটা অর্ধসমাপ্ত দিশী মদের বোতল আর অর্ধেক ভর্তি একটা কাঁচের গ্লাস। শকুনের মত নাক। চওড়া ঠোঁট, চোখ দুটো ক্ষুদে ক্ষুদে।
কি চাই ডার্লিং? লোকটা বললে।
ইনি তোমার সঙ্গে আলাপ করতে চান। মিসেস ভট্টাচার্য বললেন।
হু ইজ হি? কৌন্ হ্যায় ইয়ে আদমী?
মিসেস ভট্টাচার্যের চোখেমুখে একটা বিরক্তির ভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বললেন, মিঃ রায়, বিখ্যাত সত্যসন্ধানী কিরীটী রায়
কিরীটী রায়—মানে দ্যাট ফেমাস ম্যান! ইয়েস–ইয়েস আই নো হিম।
আপনি আমাকে চেনেন? কিরীটী প্রশ্ন করল।
চিনি মানে নাম শুনেছি।
উনি তোমার সঙ্গে আলাপ করতে চান। মিসেস ভট্টাচার্য বললেন।
বাট আই অ্যাম অ্যান অর্ডিনারী পার্সন!
কি যে দিবারাত্র ঐ বিষগুলো গেলো! মিসেস ভট্টাচার্য বিরক্তি-কণ্ঠে বললেন।
বাস, দাস ফার অ্যান্ড নো ফাদার! তুমি যেতে পার।
রোষকষায়িত লোচনে স্বামীর দিকে তাকিয়ে মিসেস ভট্টাচার্য চলে গেলেন।
বসুন স্যার বসুন, বলতে বলতে একটা চেয়ার ঠেলে দিল নিবারণ ভট্টাচার্য।
কিরীটী উপবেশন করল। চলবে স্যার?
না, ধন্যবাদ।
কিন্তু স্যার, আমার মত স্ত্রীর কৃপাপ্রার্থী একটা মাতালের সঙ্গে আপনি কেন আলাপ করতে চান, বলুন তো?
আপনার হোটেলে এলাম অথচ আসল মালিকের সঙ্গে পরিচ্চ্য হবে না, তাই–
নো, নো স্যার, আসল মালিক হার একসেলেন্সি শ্রীমতী সুষমা ভট্টাচার্য। আমার কাজ অনেক দিনই ফুরিয়ে গিয়েছে, চাকরি যাবার পর টাকাটা এনে ওদের হাতে তুলে দিয়েছিলাম, অ্যান্ড দেয়ার এন্ডস দি ম্যাটার!
তাহলে তো আপনার টাকাতেই এই হোটেল চালু হয়েছিল, মিঃ ভট্টাচার্য!
না না, আমার সে টাকা নাকি অতি সামান্য–খুদকুঁড়ো—যাক সে কথা! আমাকে একটা করে বোতল দিলেই আমি সন্তুষ্ট। আর আমার প্রয়োজনটাই বা কি! এবারে বলুন মিঃ রায়, আপনি হঠাৎ আমার সঙ্গে আলাপ করতে এলেন কেন?
কিরীটী তখন মানসীর মৃত্যুর ব্যাপারটা বর্ণনা করে বললে, সেই সম্পর্কেই আপনাকে আমি কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই!
হ্যাঁ, মনে আছে আজও আমার সেই ভদ্রলোকের কথা কিন্তু সে তো অনেক দিন হয়ে গিয়েছে।
তা তো একটু হয়েছেই—
তবু বেটার লেট দ্যান নেভার!
হুঁ, তাহলে দেখছি আপনার মনেও ব্যাপারটা সন্দেহের উদ্রেক করেছে!
দেখুন মিঃ রায়, সেদিন মিসেস বোসের ঐভাবে জলে ড়ুবে মৃত্যুটা আমার কাছে কেমন যেন একটু গোলমেলেই মনে হয়েছিল—
কেন, গোলমেলে মনে হয়েছিল কেন আপনার?
কারণ মেয়েটি যেরকম সাঁতার জানত বলে শুনেছিলাম, তাতে তার ঐভাবে ড়ুবে যাওয়াটা কেমন যেন একটু অস্বাভাবিক। আরও কথা আছে এর মধ্যে মিঃ রায়—আমার অভ্যাস আছে অনেক রাত্রে সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে—একা একা সী বীচে গিয়ে হেঁটে বেড়ানো। ফলে হোটেলের সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে, আমি ঘুমাই না। দু-তিন রাত-রাত তখন একটা-দেড়টা হবে—ওদের ঘর থেকে চেঁচামেচির শব্দ শুনেছিলাম আমি–
তাই নাকি?
হ্যাঁ। একদিন তাই কৌতূহলে দোতলায় ওদের ঘরের দরজায় গিয়ে কান পাতি, কতকগুলো কথা সেরাত্রে আমার কানে এসেছিল। শুনলাম মেয়েটি বলছে, তোমার ধারণা ভুল। কারও প্রতিই আমি আকৃষ্ট নই।
ভদ্রলোক বললে, ইটস এ ড্যাম লাই! মিথ্যা, তোকে আমি বিশ্বাস করি না! কলকাতায় আমি ঘুমোলে প্রতি রাত্রে তুই সুকুমারের ঘরে যেতিস—
তুমি যেমন জঘন্য তেমনি নীচ!
তোকে আমি খুন করব—খুন করে ফাঁসি যাব।
সে কি আর আমি জানি না, তা-ই—শেষ পর্যন্ত আমার বরাতে তা-ই আছে।
তারপরই ভদ্রলোকের সে কি হাউমাউ করে কান্না স্যার!
কান্না? কিরীটীর প্রশ্ন।
হ্যাঁ। ভদ্রলোক তারপর বললে, তোকে ছাড়া আমি বাঁচব না মানসী, তুই কি চাস বল–সুকুমারকে তুই ছেড়ে দে।
মেয়েটি বললে, সুকুমারকে ও বাড়ি থেকে চলে যেতে বললেই তো পার—
না, সে হবে না। ও চলে গেলে অন্যত্র প্রেম চালাবার খুব সুবিধা হবে, না? না, তোদের দুজনকেই আমার চোখের সামনে থাকতে হবে।