কিরীটীও ঐ একই হোটেলে উঠেছিল, যে হোটেলে শরদিন্দু এসে উঠেছিল। শরদিন্দু ছিল সেই পূর্বেকার কুড়ি নম্বর ঘরে দোতলায়। পরে কিরীটী ও কৃষ্ণা ছিল ঐ দোতলাতেই চৌদ্দ নম্বর ঘরে।
পুরীতে পৌঁছেই পরের দিন বিকেলে কিরীটী গেল থানায়। সেখানে ঘনশ্যাম মোহান্তির সঙ্গে আলাপ হল। ঘনশ্যাম মোহান্তি প্রায় দুই বছর আছেন ঐ থানার ইনচার্জ-এ। বয়স বত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশের মধ্যে হবে বলে মনে হয়। বেশ হৃষ্টপুষ্ট চেহারা, মাথায় সামান্য টাক, একজোড়া পুরু গোঁফ, একবারে চেন স্মোকার যাকে বলে।
মোহান্তি কিরীটীর পরিচয় পেয়ে যথেষ্ট সমাদর করলেন। তারপর কিরীটী যখন তার পুরীতে আসার উদ্দেশ্য ব্যক্ত করল তখন মোহান্তি বললেন, হ্যাঁ, জলে ড়ুবে যাবার একটা কেস ঘটেছিল বছর দুই আগে। এক ভদ্রমহিলা বিকালের দিকে সমুদ্রে সাঁতার কাটতে গিয়ে ঢেউয়ের মধ্যে তলিয়ে যান।
কিরীটী বললে, তার মৃতদেহের কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি?
না। চার-পাঁচ দিন ধরে খোঁজ নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু মৃতদেহটা শেষ পর্যন্ত ট্রেস করা যায়নি।
ফাইলটা আছে কি আপনার কাছে? কিরীটী বলল।
আছে। বসুন আপনি।
ভিতুরের ঘরে গিয়ে কিছুক্ষণ বাদে ফাইল নিয়ে এলেন মোহান্তি।
ভদ্রমহিলার বয়স ছিল তেইশ। স্বামীর নাম শরদিন্দু বোস। বিজনেসম্যান, কলিকাতা থেকে পুরীতে এসেছিলেন বেড়াতে। দিন পাঁচেক বাদে ঐ ঘটনা ঘটে, শরদিন্দুই থানায় ডাইরি করে।
হঠাৎ কিরীটীর নজর পড়ল, থানায় ডাইরি করা হয় ঐ ঘটনার পরের দিন বিকালে, অর্থাৎ প্রায় ২৪ ঘণ্টা পরে। দুর্ঘটনা ঘটেছে আগের দিন বেলা চারটের পর, পরের দিন বেলা চারটেয় ডাইরি করা হয়। পুলিস থেকে তারপর স্থানীয় জেলে ও নুলিয়াদের দিয়ে অনেক অনুসন্ধান চালানো হয় মৃতদেহের, কিন্তু শেষ পর্যন্ত মৃতদেহ পাওয়া যায়নি। হয়তো মৃতদেহ ভাসতে ভাসতে অনেক দূরে চলে গিয়েছে, না-হয় হাঙ্গরে মৃতদেহ খেয়ে ফেলেছে।
মিঃ মোহান্তি কিরীটী বলল, তাহলে দুর্ঘটনার চব্বিশ ঘণ্টা পরে ডাইরি লেখানো হয়। ভদ্রলোক এত দেরি করে এলেন কেন বলেছিলেন কিছু?
না, তবে ঐদিনই সন্ধ্যায় কিন্তু আমরা রিপোর্টটা পেয়েছিলাম সঙ্গে সঙ্গে আমি নিজেই সী বিচে যাই–
শরদিন্দুবাবুর সঙ্গে হোটেলে দেখা করেননি?
সংবাদ পেয়ে গিয়েছিলাম রাত্র আটটা নাগাদ, কিন্তু ভদ্রলোক ছিলেন না হোটেলে। তার পরের দিনও সকালে হোটেলে যাই কিন্তু তখনও দেখা হয়নি। হোটেলের মালিক মিসেস ভট্টাচার্য বললেন, ঘরে তার তালা দেওয়া—রাত্রে ফিরেছেন কিনা তাও বলতে পারব না। অগত্যা ফিরে এলাম থানায়। তারপর বিকেল চারটে নাগাদ ভদ্রলোক এলেন থানায় ডাইরি করতে। বললেন তিনি নাকি সমুদ্রের ধারে ধারে সারাটা রাত খুঁজে বেড়িয়েছেন তার স্ত্রীর দেহটা।
কি করে তার স্ত্রী জলে ড়ুবলেন সে সম্পর্কে কিছু বলেননি তিনি?
বলেছিলেন বিকেলে যখন তারা হোটেলে বসে গল্প করেছিলেন, তাঁর স্ত্রীর সমুদ্রস্নানের ইচ্ছা হয়।
ঐ সময় কেউ সমুদ্রে স্নান করছিল?
না। লোকজন বড় একটা সে সময় সমুদ্রের আশেপাশে ছিল না। তবে কিছুদূরে এক প্যান্ট ও শার্ট পরিহিত ভদ্রলোক—চোখে চশমা ও মাথায় শোলার টুপি হাতে একটা ক্যামেরা নিয়ে সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়েছিলেন, একবার নাকি তিনি দেখেছেন। তারপর স্ত্রী সাঁতার দিতে দিতে ঢেউয়ের মাথায় মাথায় খানিকটা এগিয়ে যান, ভদ্রলোক মানা করা সত্ত্বেও শোনে না। হঠাৎ একটা ঢেউ এসে তাকে দূরে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। আর তাকে দেখতে পাওয়া যায় না। উনি সাঁতার জানতেন না বলে চেঁচামেচি শুরু করে দেন।
তারপর?
দুরে দুজন নুলিয়া ছিল—তারা ছুটে আসে কিন্তু ভদ্রমহিলাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না।
কিরীটী প্রশ্ন করলে, ঐ সময় সেই ভদ্রলোক, যিনি কিছুদূরে ক্যামেরা হাতে দাঁড়িয়েছিলেন, তিনি সাহায্য করতে এগিয়ে আসেননি?
সে সব কথা ভদ্রলোক বলেননি।
আচ্ছা মিঃ মোহান্তি, সমুদ্রে যারা মাছ ধরে তাদের কাউকে আপনি চেনেন?
একজনকে জানি, সমুদ্রে একসময় সে মাছ ধরত—এখন বয়স হয়েছে। এককালে ভাল সাঁতারুও ছিল এবং তার কাঠের ভেলার মত নৌকাটা নিয়ে সমুদ্রের মধ্যে অনেক দূরে চলে যেত মাছ ধরতে—আড়িয়া লোকটার নাম—জাতে তেলেঙ্গা—এখন অবিশ্যি মাছ টাছ আর ধরে না—আপনি যে হোটেলে উঠেছেন তারই পাশের হোটেলে নুলিয়ার কাজ করে, যাত্রীদের স্নান করায় সমুদ্রে।
আচ্ছা আজ আমি উঠছি—কিরীটী বিদায় নিল থানা থেকে।
হাঁটতে হাঁটতে সোজা চলে এল কিরীটী সমুদ্রের ধারে। সমুদ্রের পশ্চিম দিকটায় লাল আবির ঢেলে সূর্য তখন অস্তে চলেছে, বহু বায়ুসেবী সমুদ্রের ধারে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বড় বড় ঢেউগুলো। বেলাভূমির ওপরে এসে আছড়ে আছড়ে পড়ছে মুহুর্মুহুঁ। একটানা সমুদ্র গর্জন বাতাসে ভেসে আসছে।
কিরীটী সোজা মোহান্তির নির্দিষ্ট হোটেলটায় গেল। লোকটার বিশেষ খোঁজ করতে হল না। সহজেই দেখা মিলল। একটা কাল ঢ্যাঙামত প্রৌঢ় লোক। মাথার চুল সবই প্রায় পেকে গিয়েছে, শরীরের পেশীগুলো পাকান দড়ির মত। পরনে একটা লুঙ্গি—হোটেলের সামনে বারান্দায় সিঁড়ির ওপর বসে থাকতে দেখে তারই দিকে এগিয়ে যায় কিরীটী।
এই শোন!
লোকটি উঠে এল।
এখানে এই হোটেলে আড়িয়া বলে কেউ থাকে, জানিস?
সাব, আমারই নাম তো আড়িয়া আছে। তা তোর কি দরকার সাহেব আড়িয়াকে?
আছে দরকার, আয় না, ঐ সমুদ্রের ধারে গিয়ে বসি।