হঠাৎ কানে এল গাড়ির শব্দ। শরদিন্দুর আগে-আগেই ঘরের মধ্যে ঢুকলাম। শরদিন্দু আমার পশ্চাতে ঘরে ঢুকল, ঘরের দরজার অর্গল তুলে দিল। ঘরে ঢুকেই আমি আলোটা সুইচ টিপে জ্বালিয়ে দিয়েছিলাম। মনে হল, তার দু চোখের দৃষ্টিতে যেন একটা হত্যা করবার লিপ্সা, শিকারের পূর্ব মুহূর্তে বাঘ যেমন তার শিকারের দিকে তাকিয়ে থাকে তেমনি করে যেন শরদিন্দু তাকিয়ে আছে আমার দিকে। এখুনি বুঝি আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।
বুকটার মধ্যে হঠাৎ যেন কেঁপে উঠল আমার।–কি হয়েছে, অমন করে তাকিয়ে আছ কেন? ভয়ে ভয়ে বললাম।
মানসী, আমার অবর্তমানে তাহলে তুমি সুকুমারের ঘরে রাত কাটাও? কেন, কেন বলনি তুমি আমাকে বিয়ের আগে কথাটা? কেন জানতে দাওনি সত্য কথাটা?
তুমি তো জানতে চাওনি, আমি বললাম। মাথার মধ্যে তখন আমারও যেন আগুন জ্বলছে, আমিও যেন সহ্যের শেষ সীমায় এসে দাঁড়িয়েছি।
আমি জানতে চাই, বিয়ের আগে কতদূর পর্যন্ত তোমরা এগিয়েছিলে, শরদিন্দুর গলার স্বর যেন কাপছিল।
সে কথা তোমায় বলে কোন লাভ নেই বললাম আমি। মৃত্যুর জন্য আমি প্রস্তুত।
স্বৈরিণী–বেশ্যা!
ভদ্রভাবে কথা বলহারামজাদী, ভদ্রভাবে কথা বলব তোর সঙ্গে! কথাগুলো বলেই হঠাৎ দুহাত বাড়িয়ে আমার গলাটা দশ আঙুল দিয়ে চেপে ধরল শরদিন্দু খুন—আজ তোকে খুনই করে ফেলব—চাপা গলায় হিসহিস করে বললে শরদিন্দু।
হঠাৎ ঐসময় গোকুল দরজায় ধাক্কা দিল, দাদাবাবু—দাদাবাবু!
শরদিন্দুর দশ আঙুলের চাপ শিথিল হয়ে গেল। ও আমায় ছেড়ে দিয়ে দরজাটা খুলে দিল। আশ্চর্য! শরদিন্দু তখন একেবারে শান্ত, একেবারে স্বাভাবিক, তার চোখে মুখে ও কণ্ঠস্বরে ক্ষণপূর্বে যে কুটিল হিংসা তাকে ভয়ঙ্কর করে তুলেছিল তার কিছুই যেন নেই। বললে, কিরে গোকুল?
খাবে তো চল, খাবার তৈরী হয়েছে।
পরে সেই রাত্রেই হঠাৎ শরদিন্দু আমার দুহাত ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেললে, আর বলতে লাগল, ক্ষমা কর মণি আমাকে ক্ষমা কর, পশুরও অধম ব্যবহার করেছি আজ তোমার সঙ্গে আমি, বল—আমায় ক্ষমা করেছ বল!
ঘৃণায় লজ্জায় আমি যেন তখন একেবারে পাথর হয়ে গিয়েছি।
মণি বল—আমি পশু—আমি একটা পশু।
আমি বললাম, আজ বোধ হয় ড্রিঙ্ক করনি–
না।
আমি তখন বোতল থেকে গ্লাসে ড্রিংক ঢেলে দিলাম।
আমি বুঝতে পারছি ঐ শরদিন্দুর হাতেই আমার মৃত্যু আছে।
এর পর আর ডাইরি লেখা হয়নি। বোঝাই যায়, মানসী আর ডাইরি লেখবার সুযোগ পায়নি। অতল জলধির মৃত্যু তাকে গ্রাস করেছে। ঐ ঘটনার পরেই তো সে পুরী গেল স্বামীর সঙ্গে, ডাইরিটা সঙ্গে নিয়ে যায়নি। নিজেদের বাড়িতে রেখে গিয়েছিল। মানসী কি তাহলে বুঝতে পেরেছিল, আর সে ডাইরি লেখার সুযোগ পাবে না? তাই—তাই কি সে ডাইরিটা সঙ্গে নেয়নি, বাপের বাড়িতে রেখে গিয়েছিল?
কিরীটীর মনে হয়, কলকাতায় নিজের বাপের বাড়িতে তার পড়ার টেবিলে ডাইরিটা রেখে যাওয়ার দুটি কারণ থাকতে পারে—প্রথমত সে সুনিশ্চিত ভাবে বুঝতে পেরেছিল, পুরী থেকে : সে আর ফিরে আসবে না এবং দ্বিতীয়ত, যদি তার মৃত্যু সেখানে হয়ই, তাহলে একদিন না একদিন ঐ ডাইরিই তার মৃত্যুর কারণটা প্রকাশ করে দেবে।
০৭. সুকুমার জানত না
সুকুমার জানত না, গতরাত্রে অনুরূপ একটা ঘটনা দিন দুই আগে ঘটে গিয়েছে শরদিন্দুকে কেন্দ্র করেও।
রাত্রে শরদিন্দুর বড় একটা ঘুম হয় না। মধ্যরাত্রি পর্যন্ত সে বসে বসে মদ্যপান করে, তারপর একসময় শয্যায় এলিয়ে দেয় দেহটা। তখনও চোখে ঘুম আসে না—একটা আচ্ছন্ন ভাব, নেশার ঘোর মাত্র—ঘুম নয়।
তখন বোধ হয় রাত্রি বারোটা হবে, কি কিছু বেশী—হঠাৎ ঘরের মধ্যে ফোনটা বেজে উঠল।
আঃ, এই রাত্রে আবার কে ফোন করে? বিরক্তির সঙ্গে শরদিন্দু ফোনের রিসিভারটা তুলে নেয়।
হ্যালো! অপর প্রান্তে নারীকণ্ঠ।
কে? উঠে বসে শরদিন্দু।
গলা শুনে চিনতে পারছ না! আমি মানসী!
অকস্মাৎ যেন একটা শক খায় শরদিন্দু! তার মদের নেশা যেন ছুটে যায়। মানসী! তু-তুমি!
ভাবছ বোধ হয়, মরা মানুষ আবার ফোন করে কি করে, তাই না? বুঝতেই পারছ, আমি মরিনি সেদিন সমুদ্রের জলে ড়ুবে। কি হল, একেবারে যে চুপ করে গেলে বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি কথাটা?
শরদিন্দু ফোনের রিসিভারটা হাতে প্রস্তর-মূর্তির মত বসে তখন।
বিশ্বাস করতে পারছ না কথাটা, তাই না? কিন্তু সত্যিই আমি মরিনি। দুবছর আগে যাকে বিষ–
বিষ?
হ্যাঁ, বিষ। কিন্তু কেন বিষ দিয়েছিলে বলতে পার? আমাকে তুমি সন্দেহ করেছিলে, তাই না? তোমার সন্দেহ হয়েছিল সুকুমারের সঙ্গে–
না, মানসী–তুমি কোথায়–কোথা থেকে কথা বলছ? তুমি যেখানেই থাক চলে এস, আমি বুঝতে পেরেছি আমি ভুল করেছি–
কিন্তু এখন তো তা আমার পক্ষে সম্ভব নয় শরদিন্দু। দুবছর আগে যার মৃত্যু হয়েছে, আজযদি সে আবার ফিরে আসে—অনেক জটিলতা সৃষ্টি হবে। অনেক প্রশ্ন সামনে এসে দাঁড়াবে তোমার শরদিন্দু।
তবু তুমি ফিরে এস মণি—
বললাম তো, তা আর সম্ভব নয়। কিন্তু বলতে পার শরদিন্দু কেন তুমি আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিলে?
কি বলছ তুমি?
ঠিকই বলছি, মনে করে দেখ, আমার লেমন স্কোয়াশের গ্লাসে সেদিন বিষ মেশানো ছিল–
না না, আর সত্যিই যদি লেমন স্কোয়াশের গ্লাসে বিষ মেশানো হয়ে থাকে—সে আমি মিশাইনি।
বিষাক্ত সেই লেমন স্কোয়াশ খাবার পরেই আমি যখন সমুদ্রে স্নানে যাচ্ছি তুমি বারণ করোনি–কিন্তু কি দুর্দৈব দেখ, আমি মরলাম না, সমুদ্রের তলায় তলিয়েও গেলাম না তুমি কেমন করে জানবে বল যে নিশ্চিত মৃত্যুর মধ্যে থেকেও আমি বেঁচে ফিরে আসতে পারি! তাই আবার বিয়ে করলে আর একজনকে–