সুকুমার বললে, কি বলব?
কিছু বলার নেই?
তুমি বল মানসী। সুকুমার বলল।
কেন, তুমি বলতে পার না সুকুমার?
যা বলবার আগেই তো সব বলেছি। কেন, তুমি জান না! শুনতে পাওনি?
কই না তো!
তবে আর শুনে কাজ নেই।
বাবুর অমনি রাগ হয়ে গেল, বেশ, গো বেশ আমি হার মানছি, হল তো?
সুকুমার হঠাৎ দুহাত বাড়িয়ে আমাকে বুকের মধ্যে টেনে নিল।
আঃ, কি হচ্ছে ছাড়—কেউ দেখে ফেলবে, বললাম।
আরও মাস দুই পরে আবার ডাইরি লেখা। কোন তারিখ নেই। তবে লেখা :
দুমাস কোন ডাইরি লিখিনি।
আশ্চর্য, সত্যি আজও যেন সুকুমারকে বুঝতে পারলাম না। ও আমাকে চায়, বুঝতে পারি, কিন্তু বলে না স্পষ্ট করে—এ এক দুঃসহ যন্ত্রণা-ভোগ। এক যন্ত্রণার সাগর উত্তীর্ণ হওয়া। তবে ওর ভালোবাসাটা ও প্রকাশ করতে পারে না। কেন পারে না ও—আমি তো পারি, ও ছাড়া জীবনে আমার অন্য কোন পুরুষ আসতে পারে না।
আবার মাস দুই পরে ডাইরি লেখা হয়েছে :
বুঝতে পেরেছি সুকুমারের মধ্যে একটা কমপ্লেক্স আছে। হীনমন্যতার কমপ্লেক্স। কেবলই ও নিজেকে বলে, পরাশ্রয়ী। শরদিন্দুবাবু না থাকলে নাকি ওর বাঁচাটাই দুষ্কর হত।
আমার কেন যেন মনে হয় শরদিন্দুর কাছে আশ্রয় পাওয়াটাই হয়েছে ওর জীবনের সব চাইতে বড় অভিশাপ। শরদিন্দু যদি ওকে আশ্রয় না দিত, ও বোধহয় অন্য মানুষ হতে পারত। ও মরে গিয়েছে। বিয়ের পর ওকে আমি ঐ শরদিন্দুর কাছ থেকে দূরে—অনেক দূরে নিয়ে যাব।
এবারে মাস আষ্টেক বাদে ডাইরি লেখা হয়েছে। ওপরের তারিখটা ১০ই ফেব্রুয়ারি ১৯৬৫।
ও কোন দিনই বলবে না। ভাবছি এবারে আমিই ওকে বলব—আচ্ছা সুকুমার, এবার আমরা বিয়ে করলে কেমন হয়? এস, বিয়ে কর আমায়। দূর, তাই কখনও বলা যায় নাকি! ভাবতেই হাসি পাচ্ছে। কিন্তু ওকে যতটুকু চিনেছি, ও কোন দিন হয়তো মুখ ফুটে বলবে না, আমাদের বিয়ের কথা। আমাকে হয়তো ঐ কথাটা শুনবার আশায় এমনি করেই চেয়ে থাকতে হবে।
তারপর আবার—৩১শে অক্টোবর ১৯৬৫।
হঠাৎ কাল সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে বাবা বললেন, ওঁর কারখানার মালিক নাকি ওঁকে রিটায়ার। করতে বলেছেন।
কথাটা শুনে আমার প্রচণ্ড রাগ হল, এ কি অদ্ভুত খেয়াল মানুষটার! মালিক বলে যা খুশি তাই করবে নাকি! আর আমাদের সেটা সহ্য করতে হবে? না, এ হতে পারে না। আমি কাল দেখা করব মানুষটার সঙ্গে, বলব, আপনি যা খুশি তাই করতে পারেন না। একটা সংসারকে আপনি আপনার খেয়ালে নষ্ট করতে পারেন না।
১লা নভেম্বর ১৯৬৫।
গিয়েছিলাম ভদ্রলোকের অফিসে। মানুষটার চোখের দৃষ্টি কি বিশ্রী। সর্বক্ষণ আমার দিকে চেয়ে থেকেছেন, আমার এমন বিশ্রী লাগছিল। কিন্তু তবু মনে হয়, মানুষটাকে বোধ হয় যতটা খারাপ ভেবেছি ততটা খারাপ নয়।
দিন দুই পরে আবার লিখছে মানসী–
বাবার মুখে প্রথমে কথাটা শুনে সত্যিই আমার ভীষণ রাগ হয়েছিল, স্পর্ধা তো কম নয়—আমাকে বিয়ে করতে চায়! বেচারীর বোধ হয় আমাকে দেখে এতকালের কৌমার্যের আসনটা টলে গিয়েছে!
যত ভাবছি কথাটা, ততই রাগ হচ্ছে বটে কিন্তু হাসিও পাচ্ছে। বেচারী শরদিন্দু! কিন্তু যা-ই বলি না কেন, ভদ্রলোকের চেহারাটা কিন্তু পুরুষালী এবং রীতিমত হ্যাণ্ডসাম।
বাবা আজ সকালেই আমাকে ডেকে বললেন সব কথা, তারপর বললেন আমি এখন কি
করি বল্ তো মা? আমি হঠাৎ বললাম কি করে বললাম তা জানি না, বললাম, তুমি যা ভাল বুঝবে তাই করবে। আমার মতামতের জন্য অত ভাবছ কেন?
তুমি আমায় বাঁচালি মা। বেঁচে থাক, শরদিন্দু সত্যি ভদ্রলোক। তুই সুখী হবি আমি বলছি, বাবার সমস্ত মুখ জুড়ে সে এক তৃপ্তির আনন্দ!
দীর্ঘ দেড় মাস পরে আবার ডাইরি শুরু
গত প্রায় মাস দেড়েক সুকুমারের সঙ্গে দেখা হয় নি হয়তো বেশিও হতে পারে। বিয়ের পর এই বাড়িতে এসে প্রথমে যে বিস্ময়ের সম্মুখীন হলাম, সে সুকুমার।
সুকুমারকে দেখলাম। সে এসে আমাদের যে ঘরে ফুলশয্যা রচিত হয়েছিল সেই ঘরে প্রবেশ করল। ভেবেছিলাম জীবনে আর হয়তো সুকুমারের সম্মুখীন হতে হবে না, কিন্তু আমার ভাগ্যবিধাতা বোধ হয় অলক্ষ্যে হেসেছিলেন। সুকুমার এই বাড়িতেই থাকে, ও শরদিন্দুর ভাই।
ঐ পর্যন্ত লিখে ডাইরি যেন শেষ হয়েছে। অনেকগুলো শূন্য পৃষ্ঠা। কিছু লেখা নেই। কিন্তু ডাইরি যে ওখানেই শেষ হয়নি, কিরীটী বুঝতে পারল, ডাইরির শেষের দিকে এসে অনেকগুলো শূন্য পাতার পর আবার ডাইরির শুরু। মানসী লিখেছে।– মানুষের বুকের মধ্যে যে এমন একটা আক্রোশ, এমন জমাটবাঁধা ঘৃণা থাকতে পারেসত্যি যেন আমার ধারণাও অতীত ছিল।
কাল রাত্রে শরদিন্দুর অন্য রূপ দেখলাম। শরদিন্দু নেই, কি একটা ব্যবসার কাজে দিল্লী গিয়েছে, কাল ফিরবে। যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলাম, তার কামনার উগ্র তাপ থেকে। আমার দেহটা যেন সুতীক্ষ্ণ নখের আঁচড়ে একেবারে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলেছে। ক্লান্ত—বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছি যেন। সত্যি, আর যেন সহ্য করতে পারছি না।
একদিকে শরদিন্দুর ঐ অত্যাচার, অন্যদিকে সুকুমারের দুচোখের ঘৃণাভরা দৃষ্টি। চুপচাপ অন্ধকার ঘরের মধ্যে অন্ধকার জানালার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম, হঠাৎ কানে এল বেহালার করুণ সুর, কে যেন এই বাড়ির মধ্যেই কোথায় বাজাচ্ছে। কে বেহালা বাজায় এ বাড়িতে? পায়ে পায়ে একসময় ঘর থেকে বের হয়ে গেলাম। বেহালা কাঁদছে। বেহালার সুর অনুসরণ করে করে তিনতলায় চলে গেলাম। সুকুমার তার ঘরে বেহালা বাজাচ্ছিল।