- বইয়ের নামঃ মানসী তুমি
- লেখকের নামঃ নীহাররঞ্জন গুপ্ত
- বিভাগসমূহঃ গোয়েন্দা কাহিনী
০১. টেলিগ্রামটা এসেছিল বিকেলের দিকে
টেলিগ্রামটা এসেছিল বিকেলের দিকে–সংক্ষিপ্ত তার। টেলিগ্রামে লেখা ছিল : সুকুমার, বিবাহ করেছি। তোমার নতুন বৌদিকে নিয়ে আগামী শনিবার সকালের ট্রেনে পৌছাব। শরদিন্দু।
আগামী শনিবার মানে কাল বাদে পরশুই। মনে মনে হিসাব করে দেখল সুকুমার, হাতে মাত্র একটা দিন তাহলে আর আছে। কোন্ ট্রেনে এবং ঠিক কখন ট্রেনটা পৌছাবে হাওড়া স্টেশনে সেসব কিছুই নেই তারবার্তার মধ্যে।
টেলিগ্রামটা পেয়ে সুকুমার কম বিস্মিত হয়নি। তা বিস্মিত হবারই কথা। শরদিন্দুর যখন প্রায় চল্লিশ বৎসর বয়স তখনই তার প্রথমা স্ত্রী মানসী আকস্মিক ভাবে মারা যায় জলমগ্ন হয়ে সমুদ্রে স্নান করতে গিয়ে। স্ত্রী মানসীকে হারিয়ে শরদিন্দু যখন একা ফিরে এসেছিল পুরী থেকে—সুকুমার চমকে উঠেছিল।
শরদিন্দুর চোখেমুখে যেন একটা সর্বস্ব হারানোর ব্যথা, মাথার চুল উস্কোখুস্কো—চোখ দুটো রক্তজবার মত লাল। সারামুখে খোঁচা কাঁচা-পাকা দাড়ি।
সুকুমার শুধিয়েছিল, কি হয়েছে শরদিন্দুদা, তুমি একা কেন—বৌদি কোথায়?
শরদিন্দু ফ্যালফ্যাল করে শূন্যদৃষ্টিতে চেয়ে থাকে সুকুমারের মুখের দিকে।
ঠোঁট দুটো তার অল্প অল্প কাঁপছে।–মানসী নেই সুকুমার!
নেই? বিমূঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে সুকুমার শরদিন্দুর মুখের দিকে কিছুক্ষণ। সত্যি সুকুমার যেন বোবা হয়ে গিয়েছিল।
সমুদ্রে সাঁতার কাটতে গিয়ে ড়ুবে গিয়েছে মানসী।
সে কি!
অনেক বারণ করেছিলাম রে, সমুদ্রে আমার সঙ্গে স্নান করতে নেমো না কিন্তু শুনল না। আমার কথা।
আত্মীয়-পরিচিতের দল সবাই জানত শরদিন্দু কি প্রচণ্ড ভালোবাসত তার স্ত্রীকে। মানসীকে নিজে পছন্দ করেই বিবাহ করেছিল শরদিন্দু বৎসর দুই আগে।
অমন সুখী দম্পতি বড় একটা চোখে পড়ত না সচরাচর। এক দণ্ড স্ত্রীকে চোখের সামনে দেখলে যেন পাগল হয়ে যেত শরদিন্দু।
প্রথম প্রথম হাসত নীরজা স্বামীর রকমসকম দেখে। পরে কিন্তু তার মনের মধ্যে কেমন যেন একটা ভয় বাসা বেঁধেছিল। সুকুমারকে একদিন মানসী বলেছিল, জান সুকু, আমার কেন যেন বড্ড ভয় করে।
ভয়? ভয় কিসের বৌদি?
ভয় তোমার দাদার ঐ প্রচণ্ড ভালোবাসাকে।
সুকুমার হেসেছে, বলেছে, কি যে বল বৌদি!
না, না সত্যি ভাই, তোমার দাদা কাছে এলেই—আমার যেন মনে হয়—
দাদা চিরদিনই ঐরকম বৌদি। যাকে সে ভালোবাসে, তাকে যেন এক দণ্ড চোখের আড়াল করতে চায় না।
শরদিন্দুর ঔষধ তৈরির একটা কারখানা ছিল বাগমারিতে। কারখানাটা খুব বিরাটও নয়, আবার ছোটও নয়। ঔষধের ব্যাপারটা নিজে ভাল করে যাতে বুঝতে পারে বিলেতে গিয়ে তাই বি-ফারমা পাস করে এসেছিল। কারখানাটা ছিল যেন তার প্রাণ।
সকাল সাড়ে নটায় স্নান সেরে শুরু হত প্রস্তুতি। বরাবর সুকুমার দেখেছে দশটা বাজতেই শরদিন্দুর গাড়িটা বের হয়ে যেত। হেভি ব্রেকফাস্ট করে বেরুত শরদিন্দু, লাঞ্চ কারখানাতেই সারত। ফিরত সেই রাত সাড়ে নটা—কোন কোন দিন রাত দশটা—আবার সাড়ে দশটাও বেজে যেত বাড়িতে ফিরতে।
একরাশ ফাইল নিয়ে ফিরত। বাড়ি ফিরে স্নান করে ঘরে বসত। ভৃত্য গোকুল ইতিমধ্যে টেবিলে স্কচ হুইস্কির বোতল-গ্লাস রেখে যেত, মধ্যে মধ্যে গ্লাসে চুমুক দিত শরদিন্দু আর ফাইল দেখত।
রাত এগারোটা বাজলে গোকুল এসে সামনে দাঁড়াত।–খাবার কি টেবিলে দেব?
আর একটু পরে-বলে শরদিন্দু আবার তার ফাইলে মনোসংযোগ করত। গোকুল চলে যেত।
আবার আধঘণ্টা কি পঁয়তাল্লিশ মিনিট পরে গোকুল এসে সামনে দাঁড়াত।
এবার খাবার দেব টেবিলে?
দিবি—আচ্ছা দে! সুকুমার খেয়েছে?
হ্যাঁ, সুকুদাদা তো কখন খেয়ে শুয়ে পড়েছে।
সুকু আজ কারখানা থেকে কখন ফিরেছিল রে গোকুল? শরদিন্দু শুধাত।
গোকুল বলত, সুকুদাদাবাবু তো সেই সন্ধ্যাবেলাতেই ফিরে এসেছে।
শরদিন্দু হাসত। বলত, সুকুটা জীবনে কোনদিন উন্নতি করতে পারবে না।
গোকুল অনেক দিন আছে ঐ বাড়িতে। হিসেব করলে খুব কম করেও পনেরো বছর তো হবেই। সেই শরদিন্দুর বাবা রজতসিন্ধুর আমল থেকে।
খেতে খেতে প্রভু ও ভৃত্যের মধ্যে কথা হত। গোকুল একসময় বলত, এবারে একটা বিয়ে কর খোকাবাবু!
বিয়ে? খেতে খেতে তাকাত শরদিন্দু ভৃত্যের মুখের দিকে।
হ্যাঁ। এ কি একটা বাড়ি—এ যেন একটা ভূতুড়ে বাড়ি। গোকুল বলত, বয়স তো চল্লিশ হতে চললকবে আর বিয়ে করবে?
তোর মতে এবারে একটা বিয়ে করা দরকার, তাই না রে গোকুল? শরদিন্দু বলত, ঠিক বলেছিস। বিয়ে সত্যিই একটা বোধ হয় করা দরকার এবার। ঠিক আছে, সামনের মাসেই বিয়ে করে ফেলব একটা তুই দেখে নিস।
কিন্তু সে সামনের মাস আর আসত না। অবশেষে সত্যিই একদিন হঠাৎ বিয়ে করে ফেলল শরদিন্দু।
ঘটনাটা আকস্মিকই বলতে হবে।
পরেশ নন্দী কারখানার অনেক দিনের পুরাতন কর্মচারী, অ্যাকউন্টস রাখতেন। ক্রনিক হাঁপানির রোগী, প্রায়ই অসুস্থ হতেন। অফিসে আসতে পারতেন না। একদিন শরদিন্দু বললে, আপনি এবার রিটায়ার করুন পরেশবাবু।
কিন্তু স্যার–
মাসে একশো টাকা করে পেনসন পাবেন, যান এখন সামনের মাস থেকে রিটায়ার করবেন।
ঐ এক ধরনের মানুষ ছিল শরদিন্দু, যা একবার বলবে তা করবেই। পরেশ নন্দী সেটা জানতেন। তাই পরেশ নন্দী বুঝতে পারেন, তাকে রিটায়ার করতেই হবে এবারে।