ওয়াল-ব্লকের গম্ভীর সঙ্কেতধ্বনিটা যেন নিষ্ঠুর হত্যার কথাটাই জানিয়ে দিয়ে গেল। মৃত্যু আছেই। কে কবে মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পেয়েছে—এবং আসে যখন অমোঘ পরোয়ানা হাতেই এসে হাজির হয়। তবু রায়বাহাদুরের মৃত্যুটা যেন অকস্মাৎ একটা ধাক্কা দিয়েছে সবার মনেই। কোন কথা না বলে কিরীটী অতঃপর ঘরের মধ্যের পদটিা তুলে রায়বাহাদুর যেখানে শায়িত সেখানে এসে দাঁড়াল। অন্যান্য সকলেও তাকে অনুসরণ করে ওর আশেপাশে এসে দাঁড়ায়।
অদূরে সর্বপ্রথম সকলেরই দৃষ্টি পড়ে রোগীর শিয়রের কাছে, চেয়ারের উপরে উপবিষ্ট নার্সের মাথাটা চেয়ারের উপরে একপাশে হেলে রয়েছে।
।আর—আর শায়িত মুদ্রিতচক্ষু রায়বাহাদুরের বুকের ঠিক মাঝখানে সুদৃশ্য কালো বাঁটওয়ালা একটা ছোরা সমূলে বিদ্ধ হয়ে আছে—যেন নিষ্ঠুর মৃত্যুর ভয়াবহ প্রত্যক্ষ সাক্ষী দিচ্ছে।
রায়বাহাদুরের গায়ের উপরে যে সাদা চাদরটি ছিল সেই চাদর সমেতই ছোরাটা ভেদ করে গিয়েছে। কিন্তু ছোরাটার কালো বাঁটের চার পাশে লাল রক্তচিহ্ন শুভ্র চাদরের উপরে যেন ভয়াবহ একটা বিভীষিকার মত মনে হয়।
কোন প্রয়োজন ছিল না, তথাপি ডাঃ সানিয়াল প্রথমেই রায়বাহাদুরের পালস্টা দেখলেন, সব শেষ! অনেকক্ষণ মারা গেছেন।
কিরীটী প্রথমে নার্সের নাম ধরে ডাকে, কিন্তু সাড়া না পেয়ে এগিয়ে উপবিষ্ট ও নিদ্রিত নার্সকে ঠেলে জাগাতে গিয়ে দেখে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন নার্স।
কিরীটীর বুঝতে কষ্ট হয় না যে স্বাভাবিক ঘুম নয়। কোন তীব্র ঘুমের ওষুধের সাহায্যেই নার্সকে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন করা হয়েছে, সম্ভবতঃ ইচ্ছে করেই।
ডাক্তার দুজনও ইতিমধ্যে নার্সের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে ডাঃ সানিয়াল ঘুমন্ত নার্সকে পরীক্ষা করতে উদ্যত হন, কিরীটী সরে দাঁড়ায়।
অপলক দৃষ্টিতে কিরীটী নিহত, মুদ্রিতচক্ষু রায়বাহাদুরের মুখের দিকে চেয়ে ছিল। সমস্ত মুখখানা জুড়ে যেন ফুটে উঠেছে একটা নিষ্ঠুর অবজ্ঞার চিহ্ন।
অদূরে টেবিলের উপরিস্থিত নীলাভ দ্যুতিতে মুখখানার মধ্যে যেন কেমন এক নিদারুণ বিভীষিকা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
ঘরের মধ্যে সকলেই নিস্তব্ধ, কারও মুখে টু শব্দটি পর্যন্ত নেই।
কেবল পর্দার ওপাশের ওয়াল-ক্লকটা একঘেয়ে শব্দ করে চলেছে। মন্থর বিশ্রী টক্ টক টক্ শব্দ সেই নিশ্চলতার মধ্যে।
উঃ, কি ভয়ানক!
সকলেই যুগপৎ ঐ কথাগুলি সহসা উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ফিরে তাকাল। কথাটা বলেছিলেন দুঃশাসন চৌধুরী। কথাটা বলেই তিনি দুহাতে নিজের মুখখানা ঢাকেন।
ডাঃ সানিয়াল যেন কি একটা কথা বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু বলা হল না, ঠিক ঐসময় একটা ভারী জুতোর মচমচ শব্দ সকলের কানে প্রবেশ করে।
মচমচ শব্দে জুতো পায়ে কে যেন এই কক্ষের দিকেই এগিয়ে আসছে। মচমচমচ। জুতোর শব্দ এসে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল। কিরীটীই সর্বাগ্রে পর্দার ওদিকে পা বাড়িয়েছিল এবং পর্দার এদিকে আসতেই দেখতে পেল পুলিসের ইউনিফর্ম পরিধানে হৃষ্টপুষ্ট ভারিক্কী চেহারার এক অফিসার ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে। বারেক কিরীটী ও পুলিস অফিসারটি দুজনে দুজনের দিকে অনুসন্ধানী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। কিরীটী প্রথমে কথা বলে, আপনিই বোধ হয় এখানকার এস.পি. মিঃ দালাল?
হ্যাঁ। আপনি?
আমি! আমার নাম কিরীটী রায়। আসুন, এইমাত্র আমরা জানতে পেরেছি রায়বাহাদুর নিহত হয়েছেন।
কি বললেন! রায়বাহাদুর–উৎকণ্ঠা মিশ্রিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন পুলিশ সুপার মিঃ দালাল।
হ্যাঁ। চলুন, এই ঘরের পর্দার ওপাশে মৃতদেহ।
স্তম্ভিত নির্বাক এস.পি.দালাল যন্ত্রচালিতের ন্যায় কিরীটীকে অনুসরণ করলেন।
পর্দার এপাশে এসে পা দিতেই এবং মৃতের বক্ষে ছুরিকাবিদ্ধ রায়বাহাদুরের প্রতি নজর পড়তেই অস্ফুট কণ্ঠে আবার দালাল সাহেব বলে ওঠেন, উঃ, What a horrible sight! কি ভয়ানক! Then really he has been killed!
সত্যিই ভয়ানক! যেন পূর্বাপর সমস্ত ব্যাপারটাই একটা চরমতম বিস্ময়। একটা ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন। মাত্র ঘণ্টাখানেক আগেও যে লোকটি জীবিত ছিলেন, প্রাণস্পন্দনের মধ্যে দিয়ে নিজের সত্তাটাকে ঘোষণা করছিলেন, এই মুহূর্তে অসহায় মৃত্যুর মধ্যে যেন নিঃশেষে লোপ পেয়েছেন। নিশ্চিহ্ন হয়ে মুছে গিয়েছেন জীবনসমুদ্রের বুক থেকে। এবং এই ঘটনার মধ্যে সর্বাপেক্ষা ঘনীভূত রহস্য হচ্ছে এই যে, ঐ ছুরিকাবিদ্ধ মৃত লোকটি কেমন করে না-জানি অবধারিত অবশ্যম্ভাবী তাঁর মৃত্যুর সংবাদটি পূর্বাহ্নেই জানতে পেরেছিলেন কোন এক আশ্চর্য উপায়ে। কিন্তু সত্যিই কি জানতে পেরেছিলেন, না সেটা ডাক্তারের ভাষায় একটা সত্যিই ইলিউশন মাত্র! না, ব্যাপারটা তাঁর অসুস্থ মস্তিষ্কের উত্তেজনাপ্রসূত একটা কল্পনা মাত্র!
নার্স সুলতা করের জ্ঞান আরও আধ ঘণ্টা পরে ফিরে আসে একটু একটু করে।
ওষুধের প্রভাব হতে মুক্ত হয়ে সে ঘুম থেকে জেগে উঠল। প্রথমটায় সে কিছুই বুঝতে পারে না। চোখের ঘুম ও মনের নিষ্ক্রিয়তাটুকু যেন কেটেও কাটতে চায় না। একটা নেশার ঘোরের মত সমস্ত চেতনাকে তার এখনও আচ্ছন্ন করে আছে যেন। কিরীটীর পরামর্শে এক কাফ স্ট্রং কফি পান করার পর সুলতা যেন কতকটা ধাতস্থ হয়।
কিন্তু তাকে নানাভাবে প্রশ্ন করেও তার বক্তব্য হতে এমন কিছুই পাওয়া গেল না যা রায়বাহাদুরের মৃত্যু-রহস্যের উপরে আলোকসম্পাত করতে পারে।