কেটলী থেকে গরম জল একটা কাঁচের টি-পটে ঢেলে কফির গুঁড়া মেশালেন ডাঃ সানিয়াল। সমর সেনের প্রশ্নে তার দিকে চেয়ে বললেন, বলেন কি মশাই, অমন একটা লোকের সঙ্গে আজও পরিচয় হয়নি আপনার?
না। মৃদু হেসে সেন বলেন।
রহস্যভেদী কিরীটী রায়। ডাঃ সানিয়াল জবাব দিলেন।
আপনাকেও উনি বুঝি ডেকে এনেছেন? সমর প্রশ্ন করেন।
মৃদু হেসে কিরীটী বলে, হ্যাঁ। শুনলেন না, রায়বাহাদুরের বদ্ধ ধারণা হয়ে গেছে যে তাঁকে হত্যা করবার জন্য তাঁর চারপাশে একটা প্রকাণ্ড ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে এবং আজ রাত্রেই তাঁর মৃত্যু অবধারিত!
হঠাৎ এমন ধারণা হল কেন তাঁর?
ঠিক যে হঠাৎ হয়েছে বললে ভুলই বলা হবে ডাঃ সেন, কিরীটী বলে, তবে–
ইতিমধ্যে ডাক্তার সানিয়াল কফি তৈরী করে কিরীটী ও ডাঃ সেনকে দুকাপ দিয়ে, নিজেও এক কাপ কফি নিয়ে বসলেন।
ডাঃ সানিয়াল কফিতে এক চুমুক দিয়ে ডাঃ সেনের মুখের দিকে চেয়ে বললেন, রায়বাহাদুরকে দেখে আপনার কি মনে হল ডাঃ সেন?
মনে হল যেন একটা illusion-এ ভুগছেন, কিন্তু কতদিন থেকে এরকম হয়েছে? ডাঃ সেন বললেন।
দিন সাতেক হবে। দিন সাতেক আগে থেকেই ঐ কথাটা প্রায় বলছেন, আজকের তারিখে রাত চারটের সময় নাকি উনি নিহত হবেন।
এর আগে কখনও এ ধরণের কথা বলেননি?
না। আমি তো প্রায় মাস আষ্টেক হল এখানে আছি attending physician হয়ে—
I see—তা, আর ঐ যে সব ষড়যন্ত্রের কথা কি বলছিলেন? এবারে প্রশ্নটা করে সমর সেনই।
আপনি তো অনেকদিন এখানে আছেন, হঠাৎ এরকম ধারণা ওঁর হল কেন কিছু বলতে পারেন ডাঃ সানিয়াল?
কিরীটী এবার প্রশ্ন করল।
না। বরং আমি তো দেখতে পাচ্ছি রায়বাহাদুরের আত্মীয়স্বজনেরা আপ্রাণ চেষ্টা করছেন সর্বদা কি ভাবে ওঁকে একটু সুস্থ ও নিশ্চিন্ত রাখতে পারবেন। এ ধরণের সন্দেহ যে কি করে আসে–
ডাঃ সেন এবারে বলে, আমার কি মনে হচ্ছে জানেন, অভিশাপ—এটা একটা অর্থের, অভিশাপ ডাঃ সানিয়াল। অর্থ জিনিসটাই এমন যে না থাকলেও শান্তি নেই, আবার থাকলেও শান্তি নেই। শাঁখের করাত, এগুতেও কাটে পিছুতেও কাটে।
কিরীটী কথাটা শুনে মৃদু হাসে।
নিঃশেষিত কফির পেয়ালাটা নামিয়ে রেখে কিমোনোর পকেট থেকে একটা সিগার বের করে দেশলাই সহযোগে অগ্নিসংযোগ করল কিরীটী।
কিছুক্ষণ নিঃশব্দে ধূমপান করবার পর কিরীটী বলে, গত দশ বৎসর থেকে রায়বাহাদুরকে চিনি। A self-made man. প্রথম জীবনে কুলি রিক্রুটিং থেকে শুরু করে ক্রমে নিজের অসাধারণ চেষ্টা ও অধ্যবসায়ের দ্বারা প্রচুর অর্থের মালিক হয়েছেন। সাত-সাতটা কোল মাইনসূয়ের প্রোপাইটর হয়েছেন।
বলেন কি! ডাঃ সেন বলেন।
হ্যাঁ সত্যিই বিচিত্র মানুষটা, শুধু যে উপায়ই করেছেন তা নয়—রায়বাহাদুর শুনেছি জীবনে দানধ্যানও করেছেন প্রচুর। কথাটা বললেন ডাঃ সানিয়াল।
উঁ আমিও শুনেছি, বহু প্রতিষ্ঠানে ওঁর বহু দান আছে। জবাব দিল কিরীটী।
ডাঃ সমর সেন ও আসরে যেন নির্বাক শ্রোতা। অবাক বিস্ময়ে বিচিত্র অদ্ভুত রায়বাহাদুরের কাহিনী শুনছিল।
দরজার গায়ে এমন সময় সহসা মৃদু করাঘাত শুনতে পাওয়া গেল।
কে? ডাঃ সানিয়ালই প্রশ্ন করলেন এবং এগিয়ে গিয়ে দ্বার খুলে দিলেন।
ঘরে প্রবেশ করলেন রায়বাহাদুরের ভাই দুঃশাসন চৌধুরী।
এবং কক্ষের মধ্যে উপবিষ্ট কিরীটী ও ডাঃ সমর সেনকে লক্ষ্য না করেই ডাঃ সানিয়ালকে বলেন, ডাক্তার, আমাকে একটা ঘুমের ওষুধ দিতে পার? কিছুতেই ঘুমোতে পারছি না। ঘুম আসছে না। এ আর তো পারি না—এক মাস হল, আর কত না ঘুমিয়ে কাটাব–
এখানে তো আমি কোন ওষুধ রাখি না মিঃ চৌধুরী। ও-ঘরে অনেক রকমের ঘুমের ওষুধ আছে। আমার নাম করে নার্সের কাছে চান গিয়ে, সে দেবেখন।
ওসব সাধারণ বারবিউটন গ্রুপ অফ ড্রাগসূয়ে আমার কিছু হবে না। সব খেয়ে দেখেছি। বরং যদি আমাকে একটু মরফিয়া injection করে দাও হাফ গ্রেন
মরফিয়া! বিস্মিত ডাঃ সানিয়াল যেন কতকটা আত্মগত ভাবেই কথাটা উচ্চারণ করেন।
হ্যাঁ, মরফিয়া। আচ্ছা থাক, আজও যা হোক একটা কিছু খেয়েই দেখিবলতে বলতে দুঃশাসন চৌধুরী প্রস্থান করলেন।
ওঁরা আবার গল্প শুরু করলেন।
.
আরও আধ ঘণ্টাটাক পরে।
সহসা কতকটা যেন ঝড়ের বেগেই বৃদ্ধগোছের একটি ভৃত্য ঘরের দরজার সামনে এসে উদ্বেগাকুল কণ্ঠে বলে ওঠে, ডাক্তারবাবু! ডাক্তারবাবু! শীগগিরি আসুন! কর্তাবাবুকর্তাবাবু
কিরীটী ততক্ষণে চেয়ার থেকে কতকটা যেন লাফিয়েই উঠে ছুটে দরজার গোড়ায় এসে দাঁড়ায়।
কি — হয়েছে কতবাবুর?
খুন–খুন হয়েছেন কাবাবু!
সে কি! বিস্মিত একটা চিৎকারের মতই যেন কথাটা ডাঃ সানিয়ালের কণ্ঠ হতে নির্গত হয়।
হ্যাঁ, শীগগিরি আসুন।
সকলের আগে কিরীটী যেন ছুটে ঘর থেকে বের হয়ে গেল এবং তার পশ্চাতে ডাঃ সেন, ডাঃ সানিয়ালও বের হয়ে গেলেন।
রায়বাহাদুরের ঘরের দরজা খোলাই ছিল। কিরীটী সর্বপ্রথম ঘরের মধ্যে গিয়ে পা দিল এবং ঠিক সেই সঙ্গে সঙ্গেই ঘরের ওয়াল-ক্লকটা রাত্রি চারটে ঘোষণা করল।
ঢং ঢং ঢং ঢং…
রাত চারটে।
কিরীটীর বুকের ভেতরটা যেন ধক করে ওঠে। তাহলে সত্যিসত্যিই রায়বাহাদুরের নিজের মৃত্যুর ব্যাপারে নিজের ভবিষ্যৎবাণীটা অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেল!
কয়েকটা মুহূর্ত অতঃপর কিরীটী কেমন যেন বিহ্বল বিভ্রান্ত ভাবে ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকে, কোন কথাই তার মুখ দিয়ে বের হয় না।
০৩. ঘরের মধ্যে ঐ সময়
ঘরের মধ্যে ঐ সময় ওরা তিনজন ছাড়াও দুঃশাসন ও বৃহন্নলা চৌধুরীও উপস্থিত ছিলেন। উভয়ের চোখেমুখেই একটা অসহায় ভীতিবিহ্বল ভাব। নির্বাক এবং কেমন যেন বিস্ময়াবিভূত সকলে।