চক্ষু মুদ্রিত অবস্থাতেই রায়বাহাদুর প্রশ্ন করেন, কোথায়?
সমর আরও একটু এগিয়ে গিয়ে একেবারে রোগীর শয্যার সামনে দাঁড়াল।
রায়বাহাদুর চোখ খুললেন এবং পূর্ণ দৃষ্টিতে সমরের দিকে তাকালেন।
ডাক্তার সেন? You are Dr. Sen
হ্যাঁ।
কিন্তু you are too late! আর মাত্র দেড় ঘণ্টা সময় আছে।
সমর রায়বাহাদুরের মুখের দিকে চেয়ে থাকে কেমন যেন বোকার মত। রায়বাহাদুরের চোখ ততক্ষণে আবার মুদ্রিত হয়ে গিয়েছে।
তোমরা! You? All of youসাক্ষী থাকবে, ওরা আমায় রাত ঢারটের সময় হত্যা করেছে। কিরীটী—কিরীটীবাবু কই? তাঁকে যে এত করে আমি ডেকে নিয়ে এলাম, তিনি যদি কাছাকাছি না থাকেন তো বুঝবেন কি করে—আমার হত্যারহস্য মীমাংসা করবেন কি করে! ডাক-নার্স—মিঃ রায়কে ডাক–
নার্স বোধ হয় রায়বাহাদুরের আদেশ পালনের জন্যই পর্দার ওপাশে চলে গেল।
আপনার হাতটা একটিবার দেখতে পারি কি?
ডাঃ সমর সেন সামনের দিকে একটু ঝুঁকে প্রশ্ন করে।
পালস দেখবেন? কিন্তু কি হবে দেখে? পালস্ ঠিকই আছে—তাছাড়া যাকে আর দেড় ঘণ্টা বাদে হত্যা করা হবে তার পালস্ দেখে কি বুঝবেন? Not a natural death. Not a case of heart failure.পালস্ দেখে কি সে-মৃত্যুকে আপনি ঠেকাতে পারবেন?
কি করে জানলেন যে আর দেড় ঘণ্টার মধ্যে কেউ আপনাকে হত্যা করবে?
ভাবছেন প্রলাপ বকছি, না হয় পাগল হয়ে গেছি, না ডাঃ সেন? শুধু আপনি কেন, সকলেই তাই ভাবছেন, কিন্তু দেখবেন, এখুনি দেখবেন। দেখতে পাবেন আমার কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্য হয় কিনা। দেড় ঘণ্টা আর কতটুকু সময়–
সমর ওষুধের গ্লাসটা, একটু আগে যেটি নার্স কক্ষ থেকে বের হয়ে যাবার সময় সামনের টেবিলের উপর রেখে গিয়েছিল সেটা তুলে নিয়ে বলে, এই ঘুমের ওষুধটা খান তো। আপনার একান্তভাবে এখন ঘুমনো দরকার—একটু ঘুমতো পারলে নিশ্চয়ই সুস্থ বোধ করবেন। জেগে জেগে আপনি যত দুঃস্বপ্ন দেখছেন।
কি বললেন, দুঃস্বপ্ন-আমি জেগে জেগে দুঃস্বপ্ন দেখছি? হুঁ, দুঃস্বপ্নই বটে। দেখছি গত এক বৎসর ধরে। But it is as true as anything, একটু পরেই আপনারা জানতে পারবেন গত এক বৎসর ধরে যে অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর কথাটা আমার কাছে প্রকট হয়ে উঠছে সেটা সত্য—it is coming,—আসছে মৃত্যু, আসছে, ঘুম হবে না জানি আমি কোন ওষুধেই আর ঘুম হবে না, তবু যখন বলছেন দিন কি ওষুধ খেতে হবে। সত্যিই আমি ঘুমোত চাই। Deep, sound sleep
সমর রায়বাহাদুরকে ওষুধটা খাইয়ে দিল।
নার্সের সঙ্গে সঙ্গে এমন সময় কিরীটী রায় এসে পর্দার পাশ দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করল।
কে?
আমি কিরীটী, রায়বাহাদুর।
সমর চোখ তুলে আগন্তুকের দিকে তাকায়। কিরীটীর পরিধানে শ্লিপিং পায়জামা ও কিমোনো। দেখলেই বোঝা যায় সদ্য সে শয্যা থেকে বোধ করি উঠে এসেছে।
কোথায় ছিলেন এতক্ষণ?
এই ঘরেই তো ছিলাম।
ঘুমোচ্ছিলেন, না? এমনি করে ঘুমোলেই আপনি আমার হত্যা-রহস্যের কিনারা করেছেন আর কি! সময় যে ঘনিয়ে এল সেদিকে খেয়াল আছে?
কিরীটী মৃদু হেসে শান্ত কণ্ঠে প্রত্যুত্তর দেয়, সে তো আপনার হিসেবমত রাত চারটেয়। এখনও এক ঘণ্টার ওপরে সময় আছে।
আর সময় আছে!
তাছাড়া আপনাকে তো বলেছি, আমি একবার এসে যখন উপস্থিত হয়েছি, প্রাণ থাকতে আপনার আর কোন বিপদ যাতে না ঘটে সেই চেষ্টাই করব।
করুন। যত পারেন চেষ্টা করুন কিন্তু বাধা দিতে পারবেন না এও আমি জানি।
ঢং ঢং ঢং!…
রাত্রি তিনটে ঘোষিত হয় ওয়াল-ক্লকে।
রায়বাহাদুর আবার বলেন, আর এক ঘণ্টা–
আপনি এবারে একটু ঘুমোবার চেষ্টা করুন দেখি রায়বাহাদুর!
কথাটা বলে কিরীটী।
রায়বাহাদুর চোখ বুজে ছিলেন, কিরীটীর কথার কোন জবাব দিলেন না।
ঘুমোবেন না বললে কি হবে—দু-চার মিনিটের মধ্যেই রায়বাহাদুর ঘুমিয়ে পড়েছেন ওষুধের প্রভাবে, বোঝা গেল তাঁর মৃদু নাসিকাধ্বনিতে।
রায়বাহাদুর ঘুমিয়ে পড়েছেন বুঝতে পেরে কিরীটী সকলকে চোখের ইঙ্গিতে ঘর ছেড়ে চলে যেতে বলে।
একমাত্র নার্স বাদে বাকি তিনজনে বাইরে চলে আসে।
পদার এদিকে এসে ওরা দেখে একমাত্র দুঃশাসন চৌধুরী ভিন্ন বাকি দুজন—শকুনি ঘোষ ও অন্য ভদ্রলোকটি ঐ সময় সেখানে উপস্থিত নেই।
ডাঃ সানিয়াল কিরীটী ও ডাঃ সমর সেনকে লক্ষ্য করে বলেন, চলুন আমার ঘরে, আপনাদের সঙ্গে আমার কয়েকটা কথা আছে।
সকলে রোগীর ঘর থেকে বের হয়ে একেবারে লাগোয়া পাশ্ববতী কক্ষের দ্বার ঠেলে ভিতরে গিয়ে প্রবেশ করে।
ছোট্ট একখানি ঘর, রোগীর ঘরের সঙ্গে মধ্যবর্তী একটি দ্বারপথে যোগাযোগ আছে।
একটি লোহার খাটে সাধারণ একটি শয্যা বিস্তৃত। ঘরের কোণে একটি আলনায় কয়েকটি জামাকাপড় এলোমেলো ভাবে ঝুলনো। একটি ছোট্ট টেবিল। একধারে ছোট একটি নেয়ারের খাটে শয্যা বিছানো। খানকতক বই ও খাতাপত্র টেবিলের উপরে বিশৃঙ্খলভাবে ছড়ানো। খাটের নীচে একটি চামড়ার সুটকেস্।
ইলেকট্রিক স্টোভে একটা অ্যালুমিনিয়ামের কেলীতে জল ফুটছিল। খানতিনেক চেয়ারও ঘরে ছিল। বসুন। কফি তৈরি করি একটু, কারও আপত্তি নেই তো-সানিয়াল বলেন। ডাক্তার সেন বা কিরীটী কারোরই আপত্তি ছিল না। দুজনেই তাই জবাব দেয়, বেশ তো! কেলীর জল ফুটে গিয়েছিল।
ডাঃ সমর সেন কিরীটীর মুখের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করে, আপনার সঙ্গে পরিচয় নেই আমার কিরীটীবাবু।