অত্যন্ত বিরক্তিপূর্ণ চাপা ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বর : শালারা ভাবছে আমি কিছু বুঝি না! আমায় slow poison করছে, টের পাচ্ছি না, না? সব—সব জানি। সব বুঝতে পারছি, পুলিশ সাহেব মিঃ দালালকে চিঠি দিয়েছি। Conspiracy—বিরাট ষড়যন্ত্র চলেছে—সব জানিয়েছি তাকে।
কতকটা স্তম্ভিত হয়েই যেন ডাঃ সেন সেই কথাগুলো শুনছিল, হঠাৎ অন্য একটি কণ্ঠস্বরে ডাঃ সেন সামনের দিকে তাকায়। প্যান্ট-কোট পরিহিত ভদ্রলোকটি এগিয়ে এলেন এবং মৃদু মোলায়েম কণ্ঠে বললেন, আসুন ডাঃ সেন। এবং পরক্ষণেই ঘরের মধ্যে উপস্থিত প্রথম ভদ্রলোকটির দিকে নির্দেশ করে বললেন, ইনি ডাঃ সানিয়াল, দাদার attending physician.
উভয়ে উভয়কে নমস্কার ও প্রতিনমস্কার জানায়।
ওপাশে পর্দার আড়ালে অদৃশ্য কণ্ঠস্বর তখন আবার নীরব হয়ে গিয়েছে।
আপনি attending physician, অন্য কোন বড় ডাক্তার রায়বাহাদুরকে দেখেছেন কি?
সমরের কথায় মৃদু হাসির ক্ষীণ একটা আভাস ডাঃ সানিয়ালের ওষ্ঠপ্রান্তে দেখা দিয়েই আবার পরক্ষণেই মিলিয়ে যায়।
তারপর বলেন, বলুন বরং কে রায়বাহাদুরকে আজ পর্যন্ত দেখেননি! কলকাতার হেন বড় ডাক্তার নেই ওঁকে একাধিকবার এসে দেখে যাননি।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। রায়বাহাদুরের একটা ডাক্তার ফোবিয়া আছে বলতে পারেন; এক বছর ধরে এক প্রকার শয্যাগত হয়ে আছেন। আর সেই থেকে আজ পর্যন্ত অ্যানজাইনার সাতটা অ্যাটাক হয়েছে–
বিস্ময়-বিস্ফারিত চক্ষে তাকাল সমর ডাঃ সানিয়ালের মুখের দিকে এবং বলে, বলেন কি?
হ্যাঁ, ডাঃ সানিয়াল বলেন, রায়বাহাদুরের একটা নয়, দশটা নাকি হার্ট আছে। শুধু কি তাই ডাঃ সেন, ভদ্রলোকের বয়স ষাটের কোঠায়। আটবার ডবল নিউমোনিয়ার অ্যাটাক, সাতবার অ্যাকিউট ব্যাসিলারী ডিসেন্ট্রি, তিনবার পারনিসা ম্যালেরিয়া ও দুবার টাইফয়েডে ভুগেছেন। এবারের অ্যাটাকটা হার্ট অ্যাটাক থেকে শুরু হয়, বর্তমানে এক বৎসর শয্যাশায়ী। এখন জেনারেল অ্যানাসারকা উইথ কনজেসটিভ হার্ট ফেলিওর।
হুঁ। তা আমি ওঁকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি—
বেডসোর থেকে গ্যাংগ্রিন হতে চলেছে তাই আপনাকে ডাকা হয়েছে—
ও–কথাটা উচ্চারণ করে সমর চুপ করে যায়।
বুঝতে পারে না ঐজন্য এত রাত্রে এই ভাবে তাকে ঘুম ভাঙিয়ে তুলে আনবার এমন কি জরুরী প্রয়োজন ছিল।
সমর ভাবছিল, শুধু এই বাড়িটা, তার আবহাওয়া ও এখানকার বাসিন্দারাই বিচিত্র নয়, এ-বাড়ির সব কিছুই যেন কেমন বিচিত্র। কোথাও স্বাভাবিকতার যেন লেশমাত্র নেই। শুধু বিচিত্র হলেও বুঝি কথা ছিল, সেই বৈচিত্রের মধ্যে যেন একটা রহস্যের ইঙ্গিত।
ঢং করে রাত্রি আড়াইটে ঘোষণা করে ঘরের দেওয়ালে বসানো একটি ওয়াল-ক্লক ঐ সময়।
এবং সঙ্গে সঙ্গে আবার পর্দার ওপাশ থেকে শোনা গেল সেই পূর্ব কণ্ঠস্বরডাক এল, ডাক্তার!
কণ্ঠস্বরে পূর্বের মতই বিরক্তি।
ডাঃ সানিয়াল হন্তদন্ত হয়ে যেন পর্দার ওপাশে চলে গেলেন।
ওপাশের কথাবাতা স্পষ্টই শোনা যাচ্ছিল। ডাঃ সেন কান পেতে থাকে।
আমাকে ডাকছিলেন রায়বাহাদুর?
কি কর? তুমি-তুমিও ঐ ষড়যন্ত্রের মধ্যে আছ নাকি?
আজ্ঞে–
সব টের পাই। শকুনিও আছে, সে বেটাও ষড়যন্ত্র করছে। তাড়াও। তাড়াও দুঃশাসনকে তাড়াও। জান না he is dangerous
ডাক্তার সানিয়াল বোধ হয় রায়বাহাদুরের কথার কোন জবাব দিলেন না, পার্শ্ববতী নার্সকে সম্বোধন করে বললেন, নার্স, ঘুমের ওষুধটা দিয়েছিলেন?
সঙ্গে সঙ্গে রোগীর তীব্র-তীক্ষ্ণ প্রতিবাদ শোনা গেল, না না—ঘুম পাড়িয়ে তোমরা সকলে মিলে আমাকে খুন করতে চাও। আমি কিছু বুঝি না বটে, না!! Get out বের হয়ে যাও সব এখান থেকে, দূর হও। খাব না, ঘুমের ওষুধ খাব না।
ডাঃ সানিয়ালের কণ্ঠস্বর শোনা যায়। তিনি বলেন, ডাঃ বর্ধন আজ ফোনে বলেছেন ঐ ওষুধটা দিতে
একটা আর্ত যন্ত্রণাকাতর শব্দ শোনা গেল।
পরক্ষণেই আবার শোনা গেল রায়বাহাদুরের কণ্ঠস্বর : বলুক, আমি খাব না—কিন্তু যা বলেছিলাম তা করা হয়েছে? ডাঃ সেনকে কল দেওয়া হয়েছে?
হ্যাঁ, তিনি এসেছেন—
কোথায়? ডাক-ডাক তাকে—
ডাঃ সেন এবারে নিজেই পর্দার দিকে এগিয়ে যায়।
প্রকাণ্ড একটা পালঙ্কের উপরে রবারের গদি ও ব্যারেস্টের সাহায্যে রোগীকে উঁচু করে শয্যার উপরে শোয়ানো আছে।
এক কোণে ত্রিপয়ের ওপর নীল কাঁচের ডোমে ঢাকা স্বল্পশক্তির একটি বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলছে, বাতির নীলাভ আলোয় শয্যার উপরে শায়িত রোগী রায়বাহাদুর দুর্যোধন চৌধুরীর দিকে তাকাল সমর। প্রকাণ্ড উপাধানের উপরে সবঙ্গ সাদা চাদরে আচ্ছাদিত রায়বাহাদুর শুয়ে আছেন। কেবলমাত্র রোগীর মুখখানা দেখা যায় আর সব ঢাকা।
নিরাশা, ক্রোধ, বিরক্তি, বেদনা ও বিতৃষ্ণা সব কিছু যেন একসঙ্গে ফুটে উঠেছে বলিরেখাঙ্কিত রোগীর সেই মুখের ওপরে। হাড় ও চর্মসার মুখখানা, মাথার চুল ছোট ছোট করে ছাঁটা।
সমস্ত হাড়সর্বস্ব মুখখানির মধ্যে দীর্ঘ উন্নত নাসিকা যেন উদ্ধত একটা প্রশ্নের মত জেগে আছে।
চক্ষুর পাতা দুটি মুদ্রিত। পাশে দাঁড়িয়ে ডাঃ সানিয়াল ও মাথার সামনে ওষুধের গ্লাস হাতে স্থিরনির্বাক দাঁড়িয়ে তখনও একটি অল্পবয়সী অত্যন্ত সুশ্রী ক্রিশ্চান বাঙালী নার্স।
ডাঃ সেন এসেছেন—
কথাটা ডাঃ সানিয়াল রায়বাহাদুরকে জানালেন।