রায়বাহাদুরের মুখেও আমি শুনি কথাটা এবং পরে একদিন সৌভাগ্যক্রমে লুকিয়ে আড়ি পেতে গান্ধারী দেবী ও কাকা সাহেবের আলোচনাথেকে জানতে পেরেছিলাম আমি, রায়বাহাদুরকে হত্যাকারী একটা চিঠি দিয়েই কোন একটা নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে হত্যা করবার ভয় দেখিয়েছিল যদি না তিনি তাঁর উইল পরিবর্তন করেন। কিন্তু কেন? ঐভাবে একটা নির্দিষ্ট সময়ে সে হত্যার ভয় দেখিয়েছিল কেন? খুব সম্ভব যাতে করে রায়বাহাদুর কথাটা সকলকে বলেন, ও হত্যার প্রতিশোধের জন্য ব্যবস্থা করেন। অন্তত আমার ধারণা তাই। তাহলেও এ থেকে দুটো জিনিস ভাববার আছে। প্রথমতঃ অসুস্থ রায়বাহাদুর ঐ ধরনের কথা বললে চট করে সহজে কেউই বিশ্বাস তো করবেই না ব্যাপারটা—অর্থাৎ তাঁর কথার কোন গুরুত্বই দেবে না কেউ। হয়েছিলও তাই।
এ বাড়ির কেউ সেকথা বিশ্বাসই করেননি, এমন কি আমিও করতে পারিনি প্রথমটায়। ডাক্তাররাও বলেছে ওটা hallucination-এর ব্যাপার।
দ্বিতীয়ত:, খুনীর নির্বিঘ্নে হত্যা করবার একটা চমৎকার সুযোগ হাতে আসবে, ঐ ধরনের একটা কথা চাউর করে দিতে পারলে। কিন্তু যা বলছিলাম, ওদিকে তারপর খুনী হত্যার সমস্ত সন্দেহ দুঃশাসন চৌধুরীর উপরে চাপিয়ে দেবার জন্য দুঃশাসনের ছদ্মবেশে একবার গিয়ে রায়বাহাদুরকে threaten পর্যন্ত করে এসেছিল এবং সন্দেহটাকে ঘনীভূত করে তোলবার জন্য ঠিক ঐ সময়টিতেই গান্ধারী দেবীকেও রায়বাহাদুরের ঘরে ডেকে পাঠানো হয়েছিল। জানলা দরজা বন্ধ থাকায় ঘরটা ছিল অন্ধকার তাই হয়ত রায়বাহাদুর ছদ্মবেশে খুনীকে চিনতে পারেননি এবং গান্ধারী দেবীও শেষ পর্যন্ত ঘরে প্রবেশ না করবার দরুন ব্যাপারটা রহস্যাবৃতই থেকে গিয়েছিল। হত্যার রাত্রে খুনী প্রথমতঃ ডাঃ সানিয়ালের ছদ্মবেশে নার্স সুলতা করকে কফির সঙ্গে তীব্র কোন ঘুমের ওষুধ পান করিয়ে তাকে গভীর নিদ্রাভিভূত করে ফেলে। তারপর দুঃশাসনের ছদ্মবেশে রায়বাহাদুরের ঘরের সংলগ্ন বাথরুমের ভিতর দিয়ে ঘরে প্রবেশ করে রায়বাহাদুরকে হত্যা করে। হত্যার সময় তার পরিধেয় বস্ত্র রক্ত এসে লাগে। সেই রক্তমাখা বস্ত্রটা তড়িৎপদে এসে শকুনির অবর্তমানে তার ঘরের মধ্যে ছেড়ে রেখে নিজেদের জায়গায় আবার ফিরে যায়। আমি পরীক্ষা করে দেখেছি শকুনির ঘরের বাথরুমের জানলাপথে নেমে কার্নিশ দিয়ে রায়বাহাদুরের কক্ষসংলগ্ন বাথরুমে গিয়ে প্রবেশ করা যায় খুব সহজেই। শুধু তাই নয়, হত্যা করবার পর দুঃশাসনেরই ছদ্মবেশে রুচিরা দেবীর ঘরে গিয়েও তাকে হত্যার সংবাদটা দিয়ে আসে হত্যাকারী।
স্তম্ভিত নির্বাক সকলে। কারও মুখে একটি কথা নেই।
দালাল সাহেবই আবার প্রশ্ন করেন, তবে হত্যাকারী কে?
কিরীটী এবারে মৃদুকণ্ঠে জবাব দিল, এখনও আপনারা বুঝতে পারছেন না! মহামান্য কাকা সাহেব শ্রী অবিনাশ চৌধুরী।
ঘরের মধ্যে যেন বজ্রপাত হল।
কিরীটী বলে, গতকাল সকালে কাকাসাহেবের ঘরে প্রবশ করে ঘরের দেওয়ালে টাঙানো কয়েকখানা ফটো দেখেই প্রথমে তাঁর ওপর আমার সন্দেহ হয়। এককালে অবিনাশ একজন সুদক্ষ অভিনেতা ও রূপসজ্জাকর ছিলেন। ঐটিই প্রথম কারণ ও দ্বিতীয় কারণ তাঁকে সন্দেহ করবার হচ্ছে, তিনটে থেকে রাত চারটে পর্যন্ত ঐ এক ঘণ্টা সময়ে তাঁর movements-এর কোন satisfactory explanation-ই তিনি দিতে পারেননি। তৃতীয়তঃ, তাঁর ঘরের বাথরুমের সংলগ্নই হচ্ছে শকুনিবাবুর ঘরের বাথরুম। বাইরের চওড়া কানিশ দিয়ে ঐ বাথরুমে যাওয়া খুবই সহজ। চতুর্থতঃ, হয়ত উইল। উইলের ব্যাপারটা এখনও আমি জানি না তবে নিশ্চয়ই অবিনাশ চৌধুরীর ভাগে খুব সামান্যই পড়েছে। তাতেই হয়ত তিনি উইলটার অদলবদল চেয়েছিলেন। কারণ, তাঁর ভয় ছিল দুযযাধন চৌধুরীর মৃত্যুর পর হয়ত অন্যান্য সকলে তাঁর সঙ্গীতপিপাসা ও খেয়ালের খাঁই মেটাতে রাজী থাকবে না তাঁর মত।
দুঃশাসন চৌধুরী এবারে এখানে ফিরে আসা অবধিই ঐ ব্যাপারটা নিয়ে মধ্যে মধ্যে রায়বাহাদুরের সঙ্গে বচসা করতেন। তাঁর আদৌ ইচ্ছা ছিল না ঐভাবে অনর্থক প্রতি মাসে কতকগুলো টাকা নষ্ট হয়। কিন্তু নির্মম নিয়তিই এক্ষেত্রেও প্রবল হয়ে দেখা দিল। কাকা সাহেবকে তাঁর পাপের প্রায়শ্চিত্ত চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই করতে হল প্রাণ দিয়েই। একেই বলে বিধাতার বিচার বোধ হয়। কিন্তু I pity—ঐ সাবিত্রী দেবীকে! কিরীটী চুপ করে।
সাবিত্রী এক রাতের মধ্যে সম্পূর্ণ উন্মাদিনী! কখনও হাসছে, কখনও কাঁদছে।
.
শেষ পর্যন্ত কিরীটীর মধ্যস্থতায় ডাঃ সমর সেনের সঙ্গে রুচিরার বিয়ে হয়ে গেল।
কিন্তু আজও ডাক্তার সেন মধ্যে মধ্যে দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে ওঠে। তাকিয়ে আছে পলকহীন স্থির নিষ্কম্প, বিভীষিকাময় কার দুটি চক্ষু তার দিকে যেন।
হাড়-জাগানো বলিরেখাঙ্কিত মুখ, ফ্যাকাশে রক্তহীন হলদেটে চামড়া বিস্ত, কাঁচাপাকা চুলগুলি কপালের উপরে নেমে এসেছে।
বুকে বিঁধে আছে একখানি কালো বাঁটওয়ালা ছোরা সমূলে। তারপরই যেন কানে আসে কে ডাকছে তাকে।
হুজুর, হুজুর!
ডাক্তার জেগে ওঠে, কে-কে?