মাটিতে গড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই কিরীটী এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে ছুটে গিয়ে সুইচটা টিপে দিল এবং সঙ্গে সঙ্গে আগে থেকেই ফিট করা হাজার শক্তির বৈদ্যুতিক বাতিটা জ্বলে ওঠে। মুহূর্তে ঘরের অন্ধকার দূর হয়ে উজ্জ্বল আলোয় চারদিক ঝলমল করে ওঠে।
দালাল সাহেব কিরীটীর পূর্ব-নির্দেশমত এতক্ষণ তার খাটের তলাতেই ওৎ পেতে ছিলেন। তিনিও ততক্ষণে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছেন কিরীটীর পাশে।
রক্তাক্ত কলেবরে সামনের মেঝেতেই বসে হাঁপাচ্ছেন দুঃশাসন চৌধুরী। পেছনে রক্তমাখা হাতে তখনও দাঁড়িয়ে বাঈজী মুন্না, তার দুচোখে হিংসার আগুন যেন জ্বলছে। সহসা মুন্না বাঈজী পাগলের ন্যায় খিলখিল করে হেসে ওঠে, হি, হি! পাঁচ বছর ধরে তোকে খুঁজে বেড়িয়েছি। প্রতিশোধ—এতদিনে প্রতিশোধ নিয়েছি। কেমন কেমন হয়েছে!
Whats all this Mr. Roy? এতক্ষণে বিহ্বল হতচকিত দালাল সাহেবের কন্ঠে স্বর ফোটে।
কিরীটী দালাল সাহেবের প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে ততক্ষণে এগিয়ে গিয়ে ভূপতিত দুঃশাসনের ক্ষতস্থান থেকে বিদ্ধ ছোরাটা টেনে বের করতে করতে বলে, চট করে ডাক্তারকে পাশের ঘর থেকে এখুনি একবার ডেকে আনুন, মিঃ দালাল!
দালাল সাহেব ডাক্তারকে ডাকতে ছুটলেন।
প্রচুর রক্তপাতে দুঃশাসন চৌধুরীর অবস্থা তখন ক্রমশই সঙ্গীন হয়ে আসছে।
মুন্না বাঈজী তখন যেন কেমন হঠাৎ নিঝুম হয়ে গিয়েছে—বিড়বিড় করে বলে চলেছে, কেমন জব্দ! কেমন প্রতিশোধ! পাঁচ-পাঁচ বছর ধরে খুঁজে বেড়িয়েছি!
ডাঃ সানিয়াল ছুটে এলেন হন্তদন্ত হয়ে, কি ব্যাপার মিঃ রায়?
দেখুন তো! He has been stabbed!
কিন্তু দেখবার আর তখন কিছুই ছিল না। নিদারুণ ভাবে আহত ও প্রচুর রক্তপাতে চৌধুরীর অবস্থা তখন প্রায় সকল চিকিৎসার বাইরে চলে গিয়েছে। ক্রমেই নিস্তেজ হয়ে আসছে ও নাড়ী তার ক্ষীণ হতে ক্ষীণতর হয়ে আসছে; তথাপি পরীক্ষা করে বিষণ্ণভাবে মাথা নেড়ে ডাক্তার মৃদুকণ্ঠে বলে, আশা নেই, কিন্তু কেন এমন করে স্ট্যাব করল দুঃশাসনবাবুকে মিঃ রায়?
জবাব দিল মুন্না বাঈজী, আমি—আমি প্রতিশোধ নিয়েছি নারীহত্যার—vendetta.
কয়েকটা হেঁচকি তুলে চৌধুরীর দেহটা স্থির হয়ে গেল।
মরেছে। এবার আপনারা আমায় ধরতে পারেন। শুনুন পুলিস সাহেব, আমার আসল নাম সাবিত্রী। একদিন ঐ নরপিশাচ দুঃশাসন আমার নারীত্বকে এমনি করেই হত্যা করেছিল, তারই প্রতিশোধ নিতে আমি তাকে হত্যা করেছি। আমি ধরা দিচ্ছি, আমার প্রতিজ্ঞা পূর্ণ হয়েছে। এবারে, আমি ফাঁসি যেতেও প্রস্তুত।
ভুল করেছেন সাবিত্রী দেবী। গম্ভীর কঠিন কণ্ঠে কিরীটী হঠাৎ বলে।
চকিতে মুন্না বাঈজী কিরীটীর কথায় ফিরে কিরীটীর মুখের প্রতি তাকাল, ভুল করেছি!
হ্যাঁ, ভুল করেছেন। উনি তো দুঃশাসন চৌধুরী নন!
কিরীটীর কথায় ঘরের মধ্যে যেন বজ্রপাত হল এবং ঘরের মধ্যে উপস্থিত যুগপৎ সকলেই একই সময়ে বিস্ময়বিস্ফারিত নেত্রে কিরীটীর দিকে তাকায়।
হতভম্ব দালাল সাহেবই সর্বপ্রথম কথা বললেন, কি বলছেন আপনি মিঃ রায়! উনি—উনি দুঃশাসন চৌধুরী নন?
না।
তবে কে? কে উনি?
২১.
রায়বাহাদুরের হত্যাকারী! খোঁজ নিয়ে দেখুন এতক্ষণে হয়ত তীব্র কোন ঘুমের ওষুধের প্রভাবে আসল ও সত্যিকারের দুঃশাসন চৌধুরী তাঁর ঘরে গভীর নিদ্রায় অভিভূত হয়ে আছেন। দুঃশাসন চৌধুরীর ছদ্মবেশ উনি নিয়েছেন মাত্র।
এ কি বিস্ময়! সকলেই বাক্যহারা, নিস্পন্দ।
তবে উনি কে? দুঃশাসন চৌধুরী উনি নন? তবে কাকে—কাকে আমি হত্যা করলাম? বলতে বলতে পাগলের মতই মুন্না বাঈজী মৃতদেহটার উপরে লাফিয়ে পড়তে উদ্যত হতেই, চকিতে ক্ষিপ্রহস্তে কিরীটী বাঈজীকে ধরে ফেলে। তারপর শান্ত কণ্ঠে বলে, শুধু আপনারই নয় সাবিত্রী দেবী, ভুল আমারও হয়েছে। ব্যাপারটা যে শেষ পর্যন্ত এমনি দাঁড়ানে আমিও তা ভাবতে পারিনি–নইলে এই হত্যাকাণ্ডটা হয়ত ঘটত না। উঃ What a mistake—what a mistake!
.
কিরীটী বলছিল : হত্যাকারী যে কেবল অসাধারণ ক্ষিপ্র ও চতুর তাই নয়, সুদক্ষ একজন। অভিনেতাও! আগাগোড়াই সে দুঃশাসন চৌধুরীকে ধ্বংস করবার জন্য এমন চমৎকার ভাবে প্ল্যান করে হত্যার কাজে অবতীর্ণ হয়েছিল, যাতে করে রায়বাহাদুরের হত্যাপরাধের সমস্ত সন্দেহ নিঃসন্দেহে হতভাগ্য দুঃশাসন চৌধুরীর উপরে গিয়ে পড়ে। আর হয়েছিলও তাই। ব্যাপারটা অবশ্য আমি গতকালই বুঝতে পেরেছিলাম। কিন্তু সবটাই আমার অনুমানের উপরে ভিত্তি বলে গতকাল রাত্রের ঐ ফাঁদটা পেতেছিলাম—ছোরার খাপের চার ফেলে। এবং রায়বাহাদুরেরই ঘরে নিজের শয়নের ব্যবস্থা করেছিলাম শুধু জানবার জন্য, কোন্ পথে হত্যাকারী আগের রাত্রে ঐ ঘরে প্রবেশ করে হত্যা করে গিয়েছিল। অবশ্য এটা স্থির জানতাম আমি, হত্যাকারী যত চতুরই হোক না কেন, রাত্রে সেই মারাত্মক একমাত্র হত্যার নিদর্শন ছোরার খাপটি সংগ্রহ করতে তাকে আসতে হবেই। কেননা হত্যাকারীর নিশ্চয়ই স্থিরবিশ্বাস হবে অত বড় মূল্যবান হত্যার প্রমাণটা আমি অন্য কোথাও না রেখে সবদা নিজের কাছে কাছেই রাখব। এখন আপনারা সকলেই বুঝতে পেরেছেন বোধ হয় যে আমার গণনায় ভুল হয়নি। সে আমার পাতা ফাঁদে পা দিয়েছে—এসেছে সে, কিন্তু এটা ভাবিনি ঐ সঙ্গে যে সাবিত্রী অর্থাৎ মুন্না বাঈজী, যার নারীত্বের মর্যাদা একদা দুঃশাসন চৌধুরী লুণ্ঠন করেছিল, প্রতিশোধ স্পৃহায় সে গানের মুজরা নিয়ে এ দুঃশাসনেরই খোঁজে দেশদেশান্তরে গত পাঁচ বছর ধরে তীক্ষ্ণ ছোরা কোমরে খুঁজে প্রতীক্ষ্ণয় ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এবং এও বুঝিনি যে দুঃশাসনকে খুঁজে পাওয়া মাত্রই তাকে হত্যার প্রথম সুযোগেই সাবিত্রী ক্ষুদার্ত বাঘিনীর মত উপরে ঝাঁপিয়ে পড়বে। একেই বলে নিয়তি। কেউ তা রোধ করতে পারে না। ভবিতব্য অলঙঘনীয়। অনিবার্য। কিন্তু তবুও বলব হত্যাকারীর প্ল্যানটা নিঃসন্দেহে অপূর্ব। অদ্ভুত কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছে খুনী হত্যার ব্যাপারে। আগে থেকেই সমস্ত আটঘাট বেঁধে মাত্র পনের থেকে বিশ মিনিট সময়ের মধ্যে অন্য একজনের ছদ্মবেশে হত্যাকাণ্ড সমাপ্ত করে আবার সে তার নিজের জায়গায় ফিরে এসে ছদ্মবেশ ছেড়ে সব হত্যার চিহ্ন নিজের গা থেকে যেন মুছে ফেলেছে। তাহলে গোড়া থেকেই বলি। রায়বাহাদুরের কেন ধারণা কোন এক নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ে মারা যাবেন! হত্যাকারী তাঁকে চিঠি দিয়ে সেকথা জানিয়েছিল।