কিরীটী বলে, যে ছোরাটা গতরাত্রে রায়বাহাদুরকে হত্যা করবার জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল তারই শূন্য খাপটা। তাড়াতাড়িতে হত্যাকারী খাপটা ঘরের মধ্যে ভুলে ফেলে এসেছিল। সেই শূন্য চামড়ার খাপটার গায়েই হত্যাকারীর আঙুলের ছাপ পাওয়া যাবে যা থেকে সহজেই প্রমাণ। করা যাবে হত্যাকারী কে?
ঘরের মধ্যে উপস্থিত সব কটি নরনারীই একেবারে যেন বোবা। সূচ পতনের শব্দও বোধ হয় শোনা যাবে। কারও মুখে একটি শব্দ পর্যন্ত নেই।
কিরীটী আবার বলতে থাকে, আপনাদের সকলের কাছেই আমার শেষ অনুরোধ এবং সেইটুকু জানবার জন্যই আপনাদের সকলকে আমি এখানে ডেকে পাঠিয়েছি, এখনও যদি আপনাদের কারও কিছু জানা থাকে যা এখনও আপনারা গোপন করে রেখেছেন আমাকে বলুন। অন্যথায় পুলিস আপনাদের প্রত্যেককেই নাজেহালের একেবারে চূড়ান্ত করবে। অপমান ও লাঞ্ছনারও অবধি হয়ত রাখবে না। দালাল সাহেব সহজে আপনাদের কাউকে নিষ্কৃতি দেবে
জানবেন। কিন্তু তথাপি সব নিশ্চুপ। কারও বাক্যস্ফূর্তিনেই। বোবা ভীত দৃষ্টিতে কেবল পরস্পর পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে।
একজন পুলিশ অফিসার ঘরের বাইরে দ্বারের নিকট প্রহরায় দাঁড়িয়েছিল, সে এমন সময় ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে কিরীটীর কানের কাছে মুখ নিয়ে নিম্নস্বরে যেন কি বলল। কিরীটী সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে সকলকে সম্বোধন করে বলে, বেশ, আপনাদের আমি আধ ঘণ্টা সময় দিচ্ছি, পরস্পর আপনারা আলোচনা করে দেখুন। নীচের থেকে আমি আধ ঘণ্টার মধ্যেই কাজ সেরে আসছি।
চলুন। কিরীটী পুলিস অফিসারটিকে সঙ্গে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
.
নীচের একটি ঘরে নিঃশব্দে পুলিসের প্রহরায় মাথা নীচু করে একটা চেয়ারে শকুনি ঘোষ বসেছিল। কিরীটীর পদশব্দে মুখ তুলে তাকাল। চোখের ইঙ্গিতে কিরীটী পুলিসের লোকটিকে ঘর ত্যাগ করার নির্দেশ দিতেই সে ঘর থেকে নিঃশব্দে বের হয়ে গেল।
ঘরের মধ্যে আর তৃতীয় প্রাণী নেই, কিরীটী আর শকুনি ছাড়া।
কিরীটীকে একা ঘরের মধ্যে পেয়ে এতক্ষণে সহসা শকুনি কান্নায় যেন ভেঙ্গে পড়ে। অরুদ্ধ কণ্ঠে বলে, আমাকে বিশ্বাস করুন মিঃ রায়, আমি—আমি মামাকে খুন করিনি।
কিন্তু পুলিস যে সে কথা বিশ্বাস করতে চাইছে না!
কেন—কেন? আমি নিদোষ, আমি জানি না, কিছুই জানি না।
কিন্তু আপনার ঘরের কোণে একটা ধুতি পাওয়া গিয়েছে, তাতে রক্তের দাগ এল কি করে?
শকুনি নিশ্চুপ।
তাছাড়া গতকাল রাত্রে সাড়ে তিনটে থেকে রাত সাড়ে চারটে পর্যন্ত আপনি কোথায় ছিলেন? ঘরে ছিলেন না তো?
আমি—
অস্বীকার করবার চেষ্টা করবেন না। আমি বলছি আপনি ঘরে ছিলেন না—কোথায় ছিলেন? এখনও বলুন? কথার জবাব দিন?
কুণ্ডলেশ্ববাবুর ঘরে গিয়েছিলাম। দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে শকুনি জবাব দিল।
কেন গিয়েছিলেন সেখানে?
আমি—মানে—
মদ খেতে, তাই না?
শকুনি চুপ।
কতদিন ধরে মদ্যপান করছেন?
মদ্যপান!
হ্যাঁ। শমাই বোধ হয় ঐ ব্যাপারে আপনাকে রপ্ত করিয়েছেন। আজ সকালেও আপনার কথা বলবার সময় মুখে অ্যালকোহলের গন্ধ পেয়েছি।
বছরখানেক হবে।
হুঁ। তারপর কখন ফিরে আসেন সেখান থেকে কাল রাত্রে?
রাত সাড়ে চারটে হবে বোধ করি তখন।
সাধারণতঃ কি আপনি ঐ সময়েই শমার ঘরে যেতেন মদ খেতে?
হ্যাঁ। পাছে জানাজানি হয়ে যায় তাই ঐ সময়েই যেতাম তার ঘরে।
পয়সা কে যোগাত, আপনি নিশ্চয়ই?
হ্যাঁ।
ঘরে ফিরে এসে কি দেখেন?
রক্তাক্ত আমারই পরনের একটা ধুতি ঘরের কোণে মেঝেতে পড়ে আছে। প্রথমটা আমারই পরিধানের একটা ধুতিতে রক্ত দেখে এমন হকচকিয়ে গিয়েছিলাম যে কি করি বুঝে উঠতে পারিনি। তারপর রক্তের দাগগুলো কুঁজোর জল দিয়ে ধুয়ে ফেলি কাপড় থেকে।
হুঁ। আচ্ছা রায়বাহাদুরের নিহত হবার সংবাদ আপনি গতরাত্রেই পেয়েছিলেন, তাই না?
না। গতরাত্রে পাননি সংবাদটা?
না।
তবে?
আজ সকালে ঘুম ভাঙার পর জানতে পারি।
.
সেই রাতেই। রাত বোধ করি পৌনে চারটে হবে।
নিঃশব্দ নিঝুম শীতের রাত। কেবল একটুক্ষণ আগে নাইট কিপার হুম সিংয়ের খবরদারীর চিৎকারটা শোনা গিয়েছে।
সেই ঘর। গতকাল রাত্রে এই ঘরের মধ্যেই রায়বাহাদুর ছুরিকাঘাতে আততায়ীর হাতে নিষ্ঠুরভাবে নিহত হয়েছে।
আজ শূন্য সেই শয্যা। কেবল গত রাতের নীল ঘেরাটোপে ঢাকা বাতিটা আজ নেভানোনা।
ঘরের একধারে ক্যাম্পখাটের উপর নিদ্রাভিভূত কিরীটী। আর কেউ ঘরের মধ্যে এই মুহূর্তে নেই। ঘরের দেয়ালে টাঙানো দেয়াল-ঘড়িটার একঘেয়ে টকটক শব্দ কেবল শূন্য ঘরের মধ্যে যেন সজাগ সতর্কবাণী উচ্চারণ করে চলেছে অন্ধকারের মধ্যে। কিরীটী নিশ্চিন্ত মনে ঘুমুচ্ছে। সহসা নিঃশব্দে ঘরের সংলগ্ন বাথরুমের দরজাটা ধীরে ধীরে খুলে গেল। তারপরই ঘরের মধ্যে অতি-সতর্ক পদসঞ্চারে প্রবেশ করল এক ছায়ামূর্তি। ছায়ামূর্তি পায়ে পায়ে নিঃশব্দে এগিয়ে যায় নিদ্রিত কিরীটীর শয্যার দিকে।
অল্প পরে আর একটি ছায়ামূর্তি প্রবেশ করে সেই একই পথে। প্রথম ছায়ামূর্তি টেরও পেল না দ্বিতীয় ছায়ামূর্তি যে তাকে অনুসরণ করে ঘরে ঐ মুহূর্তে তার পেছনেই প্রবেশ করল অন্ধকারে।
শায়িত কিরীটীর শয্যার একেবারে কাছে এসে দাঁড়াল প্রথম ছায়ামূর্তি, আর ঠিক সেই মুহর্তে যেন চোখের পলকে ভোজবাজির মত কিরীটী একটা গড়ান দিয়ে একেবারে শয্যা থেকে নীচে পড়ে গেল এবং পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই যেন একটা আর্ত করুণ চিৎকার অন্ধকারকে চিরে দিয়ে গেল।