দালাল সাহেব কিরীটীকে বোঝাবার চেষ্টা করেন।
কিরীটী দালাল সাহেবের প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে কেবল প্রশ্ন করে, ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পাওয়া গেছে মিঃ দালাল?
হ্যাঁ। ছুরিকাঘাতে মৃত্যু হয়েছে। একেবারে হার্ট পর্যন্ত ছুরি গিয়ে ঢুকেছে।
Stomach content chemical analysis-এর জন্য পাঠানো হয়েছে?
হ্যাঁ। কিন্তু হত্যাকারীকেই যখন আমরা মুঠোর মধ্যে পেয়েছি, তখন—
মুঠোর মধ্যে পেয়েছেন—কিন্তু প্রমাণ? প্রমাণ করতে পারবেন কি উনিই রায়বাহাদুরের হত্যাকারী?
প্রমাণ? আমাদের ওর পেটের কথা টেনে বের করতে হবে। সে tactics আমার জানা আছে মিঃ রায়। তাছাড়া কিছু কিছু প্রমাণও already আমাদের হাতের মুঠোর মধ্যেই তো এসেই গেছে।
কি রকম? কি কি প্রমাণ পেয়েছেন বলুন তো, যাতে করে আপনি স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে উনিই অপরাধী, রায়বাহাদুরের হত্যাকারী?
প্রথমতঃ ধরুন, উনি অপরাধী না হলে অমন করে না বলে কয়ে হঠাৎ ওভাবে পালাতেই বা যাবেন কেন? দ্বিতীয়তঃ, অপরাধীই যদি উনি না হন এমনি করে মুখ বুজেই বা থাকবেন কেন? সা সা সব কথা যা জানেন খুলে বললেই তো পারেন।
আমি আপনাকে বলতে পারি মিঃ দালাল, ঠিক অপরাধী বলে নয়, স্রেফ ভয় পেয়েই হয়ত উনি পালাবার চেষ্টা করেছিলেন।
ভয় পেয়ে! কিসের জন্য ভয় পেয়ে?
কাপড়ে তাঁর রক্তের দাগ ছিল বলে।
রক্তের দাগ! কোন কাপড়ে?
তাঁর ঘরেই যে ধুতিটা এক কোণে পড়েছিল তাতেই রক্তের দাগ ছিল। কিন্তু একটা কথা হয়ত এখনও আপনি শোনেননি মিঃ দালাল, মৃত রায়বাহাদুর নিহত হবার কয়েকদিন আগে টাকাকড়ি ও উইলের ব্যাপার নিয়ে রায়বাহাদুর ও দুঃশাসন চৌধুরীর মধ্যে বিশ্রী একটা বচসা হয়ে যায়, এমন কি দুঃশাসন চৌধুরী রায়বাহাদুরকে নাকি threaten পর্যন্ত করেছিলেন!
বলেন কি? এখুনি তো তাহলে একবার দুঃশাসন চৌধুরীকে ডেকে ব্যাপারটা ভাল করে জেনে নেওয়া উচিত?
তাতে করে বিশেষ কিছু সুবিধা হবে বলে মনে হয় না। Most probably he will deny the whole story.
কিন্তু তাই বলে তাকে আমরা সহজে নিষ্কৃতি দেব না। কিন্তু কার মুখে কথাটা শুনলেন?
স্রেফ ঘটনাচক্রেই ব্যাপারটা জানা সম্ভব হয়েছে। আড়ি পেতে শুনেছি গান্ধারী দেবী কাকাসাহেবকে যখন কথাটা বলছিলেন।
কাকাসাহেব মানে ঐ বুড়োটা?
হ্যাঁ। রায়বাহাদুরের কাকা অবিনাশ চৌধুরী।
আমি তার সঙ্গে কথা বলতে চাই।
যান না। তিনি বোধহয় এখন তাঁর ঘরেই আছেন।
দালাল সাহেব অতঃপর হন্তদন্ত হয়েই অবিনাশ চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করবার জন্য ঘর হতে বের হয়ে গেলেন।
কিরীটী মুন্না বাঈজীর ঘরের দিকে অগ্রসর হয়।
২০-২১. কথাটা আর চাপা রাখা গেল না
কথাটা আর চাপা রাখা গেল না।
দালাল সাহেবই সকলকে ঢাক ঢোল পিটিয়ে জানিয়ে দিলেন যে, রায়বাহাদুরের হত্যাপরাধেই শকুনি ঘোষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মামার হত্যাপরাধে শকুনি ধৃত হয়েছে এবং বর্তমানে সে হাজতে বাস করছে।
শীতের বেলায় শেষ আলোর ম্লান রশ্মিটুকু একটু একটু করে ক্রমশঃ ধরিত্রীর বুক থেকে যেন মিলিয়ে গেল। সন্ধ্যার ধূসর ছায়া বাদুড়ের মত ডানা মেলে যেন চারিদিকে ঘনিয়ে আসছে একটা কালো পর্দার মত শ্রীনিলয়ের উপরে। কোথাও এতটুকু সাড়াশব্দ পর্যন্ত নেই।
অন্ধকারের সঙ্গে সঙ্গে একটা আশঙ্কা দুঃস্বপ্নের মত সকলেরই মনকে যেন আচ্ছন্ন করে ফেলছে।
সন্ধ্যা নাগাদ ডাঃ সেনও এসে শ্রীনিলয়ে উপস্থিত হলেন।
কিরীটীর ঘরের মধ্যে সকলে উপস্থিত হয়। একমাত্র দালাল সাহেব বাদে, কাকাসাহেব অবিনাশ চৌধুরী, দুঃশাসন চৌধুরী, বৃহন্নলা চৌধুরী, তার স্ত্রী পদ্মা দেবী, গান্ধারী দেবী, তাঁর মেয়ে রুচিরা দেবী, সমীর বোস, নার্স সুলতা কর, ডাঃ সানিয়াল, ডাঃ সমর সেন এবং কিরীটী নিজে।
একমাত্র কিরীটী ছাড়া ঘরের মধ্যে উপস্থিত অন্যান্য সকলের চোখেমুখেই কেমন একটা যেন আতঙ্কের ভাব। কিরীটী তার পাইপটা হাতে নিয়ে সকলের দিকে একবার তাকিয়ে বলে, আপনারা নিশ্চয় ভাবছেন আপনাদের সকলকে কেন এ-সময় এ-ঘরে আমি ডেকে এনেছি—একটু থেমে বলে, আপনারা সকলেই দালাল সাহেবের মুখে শুনেছেন রায়বাহাদুরের হত্যা-অপরাধে বোধহয় শকুনিবাবুকে পুলিস গ্রেপ্তার করেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত পুলিস অনেক চেষ্টা করা সত্ত্বেও তার মুখ থেকে কোন কথাই বের করতে পারেনি। অথচ আপনারা জানেন না কিন্তু আমি জানি, শকুনিবাবু যদি মুখ খোলেন হত্যারহস্যটা জলের মত হয়ে যাবে এখনি। কারণ তিনি এই হত্যার ব্যাপারে এমন কতকগুলো মারাত্মক কথা জানেন যা একবার পুলিসের গোচরীভূত হলে হত্যাকারী আর তখন আত্মগোপন করে থাকতে পারবে না।
কিরীটীর কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই গান্ধারী দেবী প্রশ্ন করে, তবে কি শেকো দাদাকে হত্যা করেনি?
না। বজ্রকঠিন কিরীটীর কণ্ঠস্বর, কিন্তু আমি জানি হত্যাকারী কে! হত্যাকারী যতই চতুর হোক এবং যত বুদ্ধিরই পরিচয় দিয়ে থাক না কেন, এমন একটি মারাত্মক চিহ্ন সে রায়বাহাদুরের শয্যার পাশে রেখে গিয়েছে গতরাত্রে হত্যা করতে এসে, যেটি আজ দুপরে সেই ঘরটা পুনরায় গিয়ে ভাল করে পরীক্ষা করে দেখবার সময়ই আমার নজরে পড়েছে। সেটি কি জানেন?
সকলেই চেয়ে আছে কিরীটীর মুখের দিকে স্থির অপলক দৃষ্টিতে।