সেই সম্পর্কেই আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন আমি করতে চাই।
বলুন?
কাল কত রাত পর্যন্ত আপনি গানবাজনা করেন?
রাত বোধহয় তিনটে বাজবার কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত।
তারপর বুঝি আপনি শুতে যান?
হ্যাঁ।
আবার কখন কাকাসাহেব আপনাকে ডেকে পাঠান তাঁর ঘরে?
বোধ হয় রাত সাড়ে চারটে কি পৌনে পাঁচটা হবে তখন, আকাশ ফিকে হয়ে আসছে—
অবিনাশবাবুর ঘরে ঢুকে কি দেখলেন?
দেখলাম ঘরের মধ্যে তিনি অস্থির ভাবে পায়চারি করছেন। আমার পদশব্দেও তাঁর খেয়াল হয়নি। আমিই তখন গলাখাঁকরি দিয়ে তাঁর মনোযোগ আকর্ষণ করবার চেষ্টা করলাম। এবারে তিনি আমার দিকে ফিরে তাকালেন এবং বললেন, কে, ও মুন্না—এস। আমাদের সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে মুন্না। দুযযাধন—দুর্যোধনকে কে যেন হত্যা করেছে। রায়বাহাদুর অসুস্থ, আমি তিন মাস আগে এখানে যখন আগেরবার মুজরা নিয়ে আসি তখুনি শুনে গিয়েছিলাম। এবারেও এসে শুনেছিলাম তাঁর অবস্থা নাকি একই রকম।
এবার কতদিন হল এসেছেন এখানে?
দিনপাঁচেক হল এসেছি।
সহসা এমন সময় দ্বারে করাঘাত শোনা গেল বাইরে থেকে।
কিরীটী প্রশ্ন করল, কে?
আমি দুঃশাসন। দালাল সাহেব এসেছেন, আপনাকে ডাকছেন।
কিরীটী বলে, আসুন মিঃ চৌধুরী—ভিতরে আসুন।
দুঃশাসন চৌধুরী দরজা ঠেলে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করতেই, মুন্না নিজের অজ্ঞাতেই চোখ তুলে সামনের দিকে তাকিয়েছিল।
দুঃশাসনও মুন্না বাঈজীর প্রতি দৃষ্টি পড়তেই যেন সহসা থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। পরস্পর পরস্পরের মুখের দিকে চেয়ে থাকে।
ব্যাপারটা কিরীটীর তীক্ষ্ণ সজাগ দৃষ্টি এড়ায় না, সেও ওদের দিকে তাকিয়ে থাকে।
দুঃশাসন চৌধুরীই সর্বপ্রথম যেন কতকটা আত্মগত ভাবেই অস্ফুট কণ্ঠে বললেন, কে?
কিন্তু সেই সঙ্গে তাঁর মুখের চেহারাটাই সম্পূর্ণ বদলে গেছে।
সুস্পষ্ট একটা আতঙ্ক যেন ফুটে ওঠে সমস্ত মুখখানিতে। সহসা বিচিত্র একটা হাসি যেন বাঈজীর অমন সুন্দর মুখখানিকেও বীভৎস করে তুলল। চাপা কণ্ঠে বাঈজী বলে, হ্যাঁ। খুব আশ্চর্য হয়ে গেছেন মিঃ চৌধুরী এখানে আমায় দেখে, না? মরিনি, চেয়ে দেখুন আজও বেঁচেই আছি।
বাঈজীর দিকে চেয়ে কিরীটীই এবার প্রশ্ন করল, আপনি তাহলে জানতেন না দুঃশাসনবাবু এই বাড়িতেই থাকেন?
না।
বলেন কি? আপনাদের পূর্বপরিচয় থাকা সত্ত্বেও জানতেন না? কিরীটী দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করে।
না।
আশ্চর্য! সাবিত্রী তুমি এখানে? এতক্ষণে কোনমতে কথাটা উচ্চারণ করলেন যেন শান্তকণ্ঠে দুঃশাসন চৌধুরী।
সাবিত্রী হঠাৎ হেসে ওঠে, কিন্তু পরক্ষণেই হাসিটা থামিয়ে বলে, সাবিত্রী সাবিত্রী তো অনেকদিন আগেই মারা গেছে চৌধুরী মশায়। এ যা দেখছেন বলতে পারেন তার প্রেতাত্মা। অধীনের নাম মুন্না বাঈজী।
বিষাক্ত একটা কদর্য শ্লেষ যেন বাঈজীর কণ্ঠস্বরে প্রকাশ পায়।
মুন্নার জবাব শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যেন অকস্মাৎ দুঃশাসন চৌধুরী মুন্নার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে কিরীটীর দিকে চেয়ে মৃদুকণ্ঠে বললেন, মিঃ রায়, দালাল সাহেব বোধ হয় আপনাকে ডাকছেন।
বোঝা গেল দুঃশাসন চৌধুরী যে কারণেই হোক ঘর ত্যাগ করবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
কিরীটী মৃদু হেসে বলে, যান দুঃশাসনবাবু, দালাল সাহেবকে এ-ঘরেই ডেকে নিয়ে আসুন।
সঙ্গে সঙ্গে দুঃশাসন চৌধুরী ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। মনে হল তিনি যেন বাঁচলেন।
মুন্না বাঈজী নির্বাক নিশ্চল তখনও বসে আছে। হঠাৎ কিরীটী বাঈজীকে প্রশ্ন করে, কত দিনের আলাপ আপনাদের পরস্পরের, মুন্না দেবী?
অ্যাঁ!…..যেন চমকে ওঠে বাঈজী।
শুনেছি মিঃ দুঃশাসন চৌধুরী গত পাঁচ বছর ধরে ভারতবর্ষে ছিলেন না, আপনাদের আলাপ বুঝি তারও আগে?
হ্যাঁ। তা পাঁচ বছর হবে বৈকি। হ্যাঁ, পাঁচ বছর। অস্পষ্ট ভাবেই বাঈজী কথা কটি উচ্চারণ করে।
কিরীটী লক্ষ্য করে বাঈজী অন্যমনস্ক ও চিন্তিত। সে আবার প্রশ্ন করল, ইতিমধ্যে আর আপনাদের পরস্পরের দেখাসাক্ষাৎ হয়নি বুঝি?
না। মৃদু কণ্ঠে প্রত্যুত্তর দিল বাঈজী।
এমন সময় বাইরে দালাল সাহেবের ভারী জুতোর মম্ মম্ আওয়াজটা পাওয়া গেল। এদিকেই আসছেন তিনি বোঝা গেল।
আপনি আপাততঃ যেতে পারেন, তবে আপনি আপনার ঘরে থাকবেন মুন্না দেবী। আমি ঘণ্টাখানেক বাদেই আপনার ঘরেই আসছি আবার। আপনার সঙ্গে আমার আরও কথা আছে। দালাল সাহেবের সঙ্গে কথা বলেই আমি আসছি।
দরজা ঠেলে দালাল সাহেব ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করলেন এবং বাঈজী শ্লথ চরণে বের হয়ে গেল।
আসুন দালাল সাহেব, বসুন। কিরীটী দালাল সাহেবকে আহ্বান জানাল।
দালাল সাহেব চেয়ারটার উপরে বসতে বসতে বললেন, ইয়ে বহুত তাজ্জব কি বা হ্যায় মিঃ রায়, শকুনিবাবু তো কই বাত নেহি মানতা!
কি ব্যাপার, কি মানছে না সে?
ও মু নেহি খুলতাইয়ে আপকো হাম জরুর কঁহতে হে, ওহি রায়বাহাদুরকো জান লিয়া—
বলেন কি?
হাঁ হাঁ।
অতঃপর দুজনের মধ্যে নিম্নলিখিত আলোচনা শুরু হয়।
শকুনিবাবুকে ধরে এনে হাজতের মধ্যে বন্দী করা অবধি সেই যে লোকটা মুখ বন্ধ করেছে এখন পর্যন্ত একটি কথাও ওর কাছ থেকে আদায় করতে পারেনি করিৎকমা দালাল সাহেব।
কিন্তু এও আপনাকে বলে দিচ্ছি মিঃ রায়, দালাল সাহেব বলতে লাগলেন, রায়বাহাদুরকে হত্যা করেছে ওই শকুনিই। লোকটার চেহারা আর চোখের চাউনি দেখেছেন, একেবারে পাক্কা ক্রিমিন্যালের মত।