কিরীটীর প্রশ্নে রুচিরা কেমন যেন একটু ইতস্ততঃ করতে থাকে।
বলুন?
না, মামার পায়ের শব্দ শুনে ঘরে কেউ আসছে টের পেয়ে চট করে ঘরের সংলগ্ন বাথরুমের মধ্যে গিয়ে আত্মগোপন করেছিল সমীর।
হুঁ। দুঃশাসনবাবু আপনাকে কি বলেছিলেন?
বলেছিলেন, সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে—দাদাকে ছোরা দিয়ে কে যেন হত্যা করেছে, শীগগিরি আয়-বলেই তিনি ঘর থেকে চলে যান।
তারপর?
কিন্তু সংবাদটা এত আকস্মিক যে কিছুক্ষণের জন্য আমি যেন বোবা হয়ে গিয়েছিলাম।
তারপর?
তারপর মাকে গিয়ে সংবাদ দিই।
আপনার মা ঐ সময় জেগে ছিলেন, না ঘুমিয়ে ছিলেন?
ঘুমিয়েই ছিলেন বিছানায়।
আচ্ছা একটা কথা বলতে পারেন, আপনার মা কি গরম জামা গায়ে দিয়েই রাত্রে বিছানায় ঘুমোন?
না, কেন বলুন তো?
না, তাই বলছিলাম। আপনি হয়ত জানেন না বা লক্ষ্য করবারও সময় পাননি রুচিরা দেবী, গতরাত্রে আপনি যখন আপনার মাকে দুঃসংবাদটা দিতে যান তিনি তখন জেগেই ছিলেন। অর্থাৎ ঘুমের ভান করে শয্যায় শুয়েছিলেন মাত্র। তবে এখন বুঝছি আপনার কথাই সত্যি!
রুচিরা কয়েক মুহূর্ত ফ্যালফ্যাল করে কিরীটীর মুখের দিকে চেয়ে থাকে। গতরাত্রে সে যখন তার মাকে ডাকতে যায়, মা তাহলে জেগেই ছিলেন? বিছানায় চোখ বুজে শুয়ে থেকেও ঘুমের ভান করে ছিলেন? কিন্তু কেন? তবে কি-রুচিরার চিন্তাস্রোতে বাধা পড়ল কিরীটীর প্রশ্নে!
এখন বোধ হয় বুঝতে পারছেন, গতরাত্রে আপনার ও সমীরবাবুর মধ্যে যে আলোচনাই হয়ে থাক—সমস্ত কিছুই তিনি পাশের ঘরে জেগে থাকার দরুন শুনতে পেয়েছেন!
কিন্তু কেন—মা তা করতেই বা যাবেন কেন?
কিরীটী এবারে হেসে ফেলে, তারপর স্মিতকণ্ঠে বলে, তা কেমন করে বলি বলুন! আপনাদের সাংসারিক ব্যাপার তো আমার জানা সম্ভব নয়!
But I hate simply hate this sort of spying! এ ধরনের কারও কথা আড়ি পেতে শোনা আমি অত্যন্ত ঘৃণা করি। অত্যন্ত বিরক্তিমিশ্রিত রুক্ষকণ্ঠে প্রত্যুত্তর দিল রুচিরা।
কিরীটী তার অনুমানকে যাচাই করবার এমন সুবর্ণ সুযোগটি হেলায় যেতে দিল না। সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করে, হয়ত তাঁর ইচ্ছা আপনি সমীরবাবুকেই বিবাহ করেন, তাই!
রুচিরার গোপন ব্যথার স্থানে অতর্কিতেই আঘাত করে কিরীটী। মুহূর্তে রুচিরার সমগ্র চোখমুখ রাগে ও উত্তেজনায় রক্তিম বর্ণ ধারণ করে।
তিক্ত কঠোর কণ্ঠে রুচিরা আর অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করেই বলে ওঠে, তাঁর ইচ্ছা। নিজের ভালমন্দ বিবেচনা করবার মত যথেষ্ট বয়েস হয়েছে আমার। কারোর ইচ্ছাকে আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে মেনে নেবতা সে যিনিই হোন না কেন, অন্তত রুচিরার দ্বারা তা হবে না।
শান্ত হোন রুচিরা দেবী, এসব ব্যাপারে বৃথা উত্তেজিত হয়ে তো কোন লাভ নেই। আপনি সমীরবাবুকে বিবাহ করতে চান না সে কথা সুস্পষ্টভাবে আর কাউকে না পারেন সমীরবাবুকেও তো অন্ততঃ জানিয়ে দিতে পারতেন এতদিন। আর সেই কথাই আমি একটু আগে বলছিলাম।
সেই কথাই কাল রাত্রে তাকে বলব বলে ডেকে এনেছিলাম গোপনে, কিন্তু লোভী সে —কিছুতেই আমার কথা শুনতে চাইছিল না। যাক গে, না শোনে না শুনুকতাছাড়া আজ আর বড়মামাও বেঁচে নেই, দায় থেকে আমিও মুক্ত। মার এবং বিশেষ করে তাঁরই ইচ্ছায় এ ব্যাপারটা এতদূর অগ্রসর হয়েছিল। এইখানেই এর শেষ।
আপনার বড়মামা রায়বাহাদুরই বুঝি ঐ বিবাহে ইচ্ছুক ছিলেন?
হ্যাঁ। সমীরের সঙ্গে আমার বিবাহ দিয়ে বড়মামা ঐ সমীরের গ্রাস থেকে একটা কোলিয়ারী বাঁচাতে চেয়েছিলেন। মাত্র দিন-দুই হল দাদুর মুখে আমি কথাটা জানতে পেরেছি। আগে তো জানতেই পারিনি।
কে? অবিনাশবাবু আপনাকে বলেছিলেন ও-কথা?
হ্যাঁ। আমি অবিশ্যি প্রথম থেকেই কথাটায় আমল দিইনি। কিন্তু বিশেষ করে ঐ কথাটা কয়েকদিন আগে জানবার পর কাল রাত্রে খোলাখুলি ভাবেই আমার অমত জানিয়ে দেব ভেবেছিলাম সমীরকে ডেকে এনে।
রুচিরার গতরাত্রের সত্নরচিত গোপনতার আড়ালটুকু কিরীটী সুকৌশলে আঘাতের পর আঘাত দিয়ে ভেঙে একেবারে চুরমার করে দিল। রুচিরা সব কিছু অতঃপর প্রকাশ করে দিল।
আর একটা কথার জবাব চাই আমি আপনার কাছ থেকে মিস মিত্র।
কি?
গতকাল আপনার ছোটমামা যখন আপনাকে রায়বাহাদুরের নিহত হবার সংবাদটা দেওয়ার কথা অস্বীকার করলেন তখন আপনি তাঁকে বলেছিলেন—তাঁর কীর্তির কথা নাকি কারও জানতে বাকি নেই! কেন তাঁকে সে কথা আপনি বলেছিলেন বলবেন কি?
কি আর—এই বিষয়সম্পত্তি নিয়ে ওঁর এইখানে আসা অবধিই তো বড়মামার সঙ্গে নিত্য প্রায় খিটিমিটি চেঁচামেচি হত, বড়মামা যে অসুস্থ এই সামান্য কথাটাও যেন উনি ভুলে যেতেন—
তাই কি?
শুধু কি তাই! বলতে লজ্জা হয় মিঃ রায়, মার মুখে শুনেছি—একদিন নাকি উইলের ব্যাপারে ছোটমামা threaten পর্যন্ত করেছেন!
১৯. কিরীটী রুচিরাকে বিদায় দিয়ে
কিরীটী রুচিরাকে বিদায় দিয়ে ডেকে পাঠিয়েছে মুন্না বাঈজীকে।
মুন্না বাঈজী ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল।
বসুন, নমস্কার। কিরীটী চোখের ইঙ্গিতে তার সম্মুখস্থিত শূন্য চেয়ারটি দেখিয়ে দিল।
মুন্না নিঃশব্দে উপবেশন করে।
আমাকে আপনি ডেকেছিলেন মিঃ রায়? প্রতিনমস্কার করে মুন্না প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ। গতরাত্রে এ বাড়িতে যে দুর্ঘটনাটা ঘটে গেছে, সব শুনেছেন বোধ হয়?
হ্যাঁ।
কার কাছে শুনলেন?
বাবুর মুখেই শুনেছি। গত রাত্রেই সব আমাকে তিনি বলেছেন।