কি জানতে চান বলুন?
গত রাত্রে আপনার মামার নিহত হবার কথাটা জানবার আগে আপনি কোথায় ছিলেন ও কি অবস্থায় ছিলেন? অর্থাৎ ঠিক ঐ সময়টাতে-সোয়া তিনটে থেকে পৌনে চারটে পর্যন্ত আপনি জেগে ছিলেন, না ঘুমিয়ে ছিলেন?
মুহূর্তকাল কিরীটীর মুখের দিকে চেয়ে অত্যন্ত মৃদু কণ্ঠে রুচিরা জবাব দেয়, আমি আমার ঘরে তখনও জেগেই ছিলাম। ঘুম আসছিল না বলে শুয়ে শুয়ে একটা উপন্যাস পড়ছিলাম।
কিরীটীর মনে হয় রুচিরা যেন শেষের দিকে একটু ইতস্ততঃ করে কথাটা শেষ করল।
হুঁ, কাল তাহলে মিথ্যে কথা বলেছিলেন যে আপনি ঐ সময় ঘুমোচ্ছিলেন! যাক গে, কাল রাত্রের মতই এমনি রাত জেগে উপন্যাস পড়াটাই কি আপনার অভ্যাস?
না। তবে ঘুম না আসা পর্যন্ত পড়ি।
পাশের ঘরে আপনার মা ঘুমিয়ে ছিলেন?
হ্যাঁ।
কিরীটী ক্ষণকাল আবার চুপ করে থাকে। অতঃপর বলে, কেউ আপনার ঘরে ঐ সময় আর ছিল না?
রুচিরা মুহূর্তকাল যেন আবার একটু ইতস্ততঃ করে, তারপর বললে, না।
জবাবটা মৃদু। হঠাৎ কিরীটী বলে ওঠে, শুনুন রুচিরা দেবী, সকালবেলা তখন নটা-দশটার সময়ই হবে, আপনি যখন আপনার ঘরে ছিলেন না, সেই সময় আপনার ঘরের মধ্যে আপনার বিনানুমতিতেই আমাকে একবার বাধ্য হয়েই যেতে হয়েছিল—
আপনি আমার ঘরে গিয়েছিলেন! বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকায় রুচিরা কিরীটীর মুখের দিকে।
হ্যাঁ, শুধু আপনার ঘরেই নয়—আপনাদের প্রত্যেককেই না জানিয়ে প্রত্যেকের ঘরেই আমাকে যেতে হয়েছিল। অবশ্য ক্ষমা চাইছি সেজন্য। এবং জানেন না আপনারা কেউ যে, প্রত্যেকের ঘরেই আমি কিছু-না-কিছু সূত্রের সন্ধান পেয়েছি।
সূত্রের সন্ধান!
হ্যাঁ।
আমার ঘরে? রুচিরা হঠাৎ যেন প্রশ্নটা করে।
হ্যাঁ, আপনার ঘরেও। বলতে বলতে কিরীটী পকেটের মধ্যে সহসা হাত ঢুকিয়ে কয়েকটি দগ্ধাবশেষ সিগারেটের অংশ বের করে প্রসারিত হাতের পাতার উপর রেখে হাতটা রুচিরা দেবীর চোখের সামনে এগিয়ে ধরল এবং মৃদুকণ্ঠে বললে, এই বিশেষ সিগারেটের দগ্ধাবশেষগুলো আপনার ঘরের মেঝেতে কুড়িয়ে পেয়েছি মিস মিত্র। Special Turkish brand সিগারেট! নিশ্চয়ই আপনার ধূমপানের অভ্যাস নেই?
স্তম্ভিত নির্বাক, অসহায় দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ রুচিরা কিরীটীর প্রসারিত হাতের উপর রক্ষিত সিগারেটের অংশগুলির দিকে চেয়ে থাকে।
সামান্য শব্দও তার কণ্ঠ থেকে নির্গত হয় না।
আরও বলছি শুনুন, খোঁজ নিয়ে জেনেছি গতরাত্রে এ বাড়িতে যাঁরা উপস্থিত ছিলেন তাঁদের মধ্যে একমাত্র সমীরবাবুই এই brand-এর সিগারেটে অভ্যস্ত এবং একটু বেশী মাত্রাতেই ধূমপান করে থাকেন তিনি।
নিষ্করুণ ও কঠোর কিরীটীর অদ্ভুত শান্ত কণ্ঠস্বর।
অব্যর্থ তীক্ষ্ণ শর সে যেন নিক্ষেপ করেছে।
শরাহত পক্ষিণীর দৃষ্টি রুচিরার দুই চোখের তারায় ঘনিয়ে ওঠে। একটা বোবা যন্ত্রণা যেন তার চোখমুখে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
রুচিরা দেবী! আবার কিরীটীর কণ্ঠস্বর শোনা গেল, এবারে বলবেন কি, অত রাত্রে সমীরবাবু কেন আপনার ঘরে গিয়েছিলেন? এবং কখনই বা গিয়েছিলেন, আর কতক্ষণই বা সেখানে মানে আপনার ঘরে ছিলেন?
তথাপি নির্বাক রুচিরা।
জবাব দিন রুচিরা দেবী! রায়বাহাদুরের হত্যার ব্যাপারে একবার যদি আপনি তালিকার মধ্যে এসে যান, আপনারও অবস্থা ঠিক আপনার মাসতুতো ভাই শকুনির মতই হবে—হাজত
একটা অস্ফুট আর্ত শব্দ কেবল রুচিরার কণ্ঠ হতে নির্গত হল। কিন্তু কোন কথাই সে বলতে পারল না।
কিরীটী আবার বলে, শুনুন, মিথ্যে আপনি নিজেকে গোলমালের মধ্যে জড়িয়ে ফেলছেন। হত্যার ব্যাপারে সন্দেহ—এ ঠিক মাকড়সার বিষাক্ত রস-গরল। গরল গায়ে লাগলেই ঘা দেখা দেবে। Come out with it! বলুন–
বিশ্বাস করুন মিঃ রায়, সত্যিই আমি মামার হত্যার ব্যাপারের কিছুই জানি না।
অত্যন্ত দ্রুত কথাগুলি বলে রুচিরা যেন হাঁপাতে থাকে।
সে কথা তো আপনাকে আমি জিজ্ঞাসা করিনি। আমি জিজ্ঞাসা করছি কাল রাত্রে কখন সমীরবাবু আপনার ঘরে গিয়েছিলেন এবং কতক্ষণই বা ছিলেন? কেনই বা গিয়েছিলেন এবং তিনি স্ব-ইচ্ছায়ই গিয়েছিলেন, না আপনিই তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন? বলুন জবাব দিন!
আ—আমি তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছিলাম।
আপনি?
হ্যাঁ।
কখন গিয়েছিলেন তিনি?
রাত তিনটে বাজার বোধ হয় কয়েক মিনিট পরেই। বই বন্ধ করে আমি শুতে যাব, ঠিক এমনি সময় তিনি আমার ঘরে এসে ঢোকেন।
অত রাতে তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন?
না, সন্ধ্যার সময় ডেকেছিলাম—এসেছিলেন ঐ সময়।
হুঁ, তাহলে রায়বাহাদুরের ঘর থেকে বের হয়ে সোজা তিনি আপনার ঘরেই এসে ঢুকেছিলেন! কতক্ষণ ছিলেন?
বোধ করি আধঘণ্টাটাক হবে।
আধ ঘণ্টা, না ঘণ্টাখানেক?
তা ঘণ্টাখানেকও হতে পারে।
হুঁ। ঘণ্টাখানেক যদি হয় তাহলে রাত তিনটে থেকে চারটে পর্যন্ত আপনারা দুজনে আপনার ঘরেই ছিলেন?
হ্যাঁ।
কিন্তু কেন তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন?
সমরের কথাটা বলতেই।
বলেছেন তাঁকে?
না।
কেন?
সুযোগ পাইনি।
কেন?
কেবলই তিনি অন্য কথা বলতে লাগলেন!
এবারে কিরীটীর দ্বিতীয় শর নিক্ষিপ্ত হল রুচিরার প্রতি, দ্বিতীয় প্রশ্ন।
এবারে বলুন রায়বাহাদুরের মৃত্যুসংবাদটা আপনাদের কে দিয়েছিল?
সে তো কালই বলেছি, ছোটমামা!
দুঃশাসনবাবু?
হ্যাঁ।
দুঃশাসনবাবু যখন আপনাকে খবরটা দেন, সে সময় সমীরবাবুও সেখানে উপস্থিত ছিলেন কি?