ডাঃ সানিয়াল যেন চমকে ওঠেন কিরীটীর শেষের কথায়।
তাই-ই ডাক্তার, কারণ মহাভারতের উপাখ্যানের সঙ্গে এখানে সামান্য একটু উল্টোপাল্টা হয়ে গিয়েছে। মাতুল না হয়ে এখানে হয়েছেন ভাগিনেয়। দুর্যোধন মাতুল, ভাগিনেয় শকুনি।
বিস্মিত দৃষ্টিতে ডাক্তার কিরীটীর মুখের দিকে তাকায়।
শকুনি!
হ্যাঁ। সংবাদটা কিন্তু আপনার রাখা উচিত ছিল।
শকুনি?
তাই। আশ্চর্য, এই সহজ ব্যাপারটা আপনার চোখে পড়েনি! সুলতা দেবীর প্রতি শকুনির চাউনিটাই তো ইতিপূর্বে আমার কাছে সংবাদটা ব্যক্ত করেছিল ডাক্তার!
কিন্তু সুলতা–
তা অবশ্য আমার চাইতে আপনারই বেশী জানবার কথা। কিন্তু রাত্রে কফি দিতে গিয়ে যে এদিকে আপনি একটা প্রচণ্ড জটিলতার সৃষ্টি করে ফেলেছেন!
জটিলতা!
হ্যাঁ। প্রতি রাত্রেই তাকে আপনি কফি দিয়ে আসতেন ইদানীং, তাই তো?
ডাক্তার সানিয়াল লজ্জায় আবার দৃষ্টি নত করলেন।
সুলতা দেবী বলেছেন, গতরাত্রেও নাকি আপনিই তাকে কফি দিয়ে এসেছেন অথচ তার জানা নেই যে আমরা আপনার ঘরে ঠিক গতরাত্রে ঐ সময়টায় উপস্থিত থাকায় লজ্জা। এসে আপনাকে আপনার চরণ ধরে বাধা দিয়েছিল।
কি বলছেন আপনি মিঃ রায়! আমি তো কাল–
জানি। আপনি তাকে কফি দেননি—অন্ততঃ গতকাল রাত্রে। অথচ মজা কি জানেন, আপনি দিলেও লোকে জেনেছে আপনিই দিয়ে এসেছেন। শুধু তাই নয়, যাকে দিয়েছেন তারও। সুনিশ্চিত ধারণা তাই।
সে কি!
হ্যাঁ। একেই বলে শয়তানীর চাতুরী…..
কিন্তু কিরীটীর বক্তব্য শেষ হল না, বাইরে থেকে বন্ধ দরজার কপাটের গায়ে অত্যন্ত মৃদু একটা করাঘাত শোনা গেল।
নিশ্চয়ই রুচিরা দেবী! আপনি একটু অনুগ্রহ করে বাইরে যান ডাক্তার ওপাশের ঐ দরজাটা দিয়ে, ওঁর সঙ্গে আমার কয়েকটি কথা আছে।
নিশ্চয়ই। ডাঃ সানিয়াল আর কোনরূপ মন্তব্য না করেই কিরীটীর নির্দেশমত ঘরের দ্বিতীয় দ্বারপথে বের হয়ে গেলেন।
এবং পরক্ষণেই দরজার গায়ে আবার মৃদু করাঘাত শোনা গেল।
আসুন রুচিরা দেবী! কিরীটী মৃদু কণ্ঠে আহ্বান জানায়।
রুচিরাই।
রুচিরা দ্বার ঠেলে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল।
কিরীটী মৃদু শান্ত কণ্ঠে বলে রুচিরাকে, আসুন। বসুন ঐ চেয়ারটায় রুচিরা দেবী।
রুচিরা নিঃশব্দে কিরীটী-নির্দিষ্ট চেয়ারটা টেনে নিয়ে বারেকের জন্য কিরীটীর মুখের দিকে চেয়ে একেবারে কিরীটীর মুখোমুখি বসল।
খোলা জানালাপথে শীতের পড়ন্ত রৌদ্রালোক ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করেছে। দিনশেষের শেষ লিপি যেন।
কিরীটী রুচিরার দিকে চেয়ে থাকে নিঃশব্দে।
রুচিরার পরিধানে একটা গেরুয়া রঙের দামী মিলের শাড়ি। গায়ে একটা ফিকে আকাশ-নীল রঙের দামী কাশ্মীরী শাল জড়ানো। মাথায় তৈলহীন রুক্ষ চুল এলো খোঁপা করে বাঁধা অবস্থায় কাঁধের একপাশে পাকার হয়ে আছে। সত্যিই অপূর্ব সুন্দরী রুচিরা।
কিরীটী তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে রুচিরাকে দেখছিল। গতরাত্রে প্রথম দৃষ্টিতে যাকে ষোল-সতের বছরের যুবতী বলে মনে হয়েছিল, সুস্পষ্ট দিনের আলোয় তাকে পুনবার ভাল করে দেখতেই যেন তার সে ভুল ভেঙে যায়। মুখখানি অতীব কমনীয় ও ঢলঢলে হলেও রুচিরার বয়স তেইশ-চব্বিশের কম নয়, বরং দু-এক বছর বেশীও হতে পারে।
অতঃপর কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতার মধ্যে অতিবাহিত হবার পর কিরীটী প্রশ্ন করে সর্বপ্রথমে, আপনি তো কলকাতায় বেথুনে পড়েন রুচিরা দেবী?
হ্যাঁ, আমার ফোর্থ ইয়ার।
যদি কিছু মনে না করেন, জিজ্ঞাসা করতে পারি কি, আপনার বর্তমান বয়স কত হল?
বোধ হয় চব্বিশ। মৃদু অনাসক্ত কণ্ঠে রুচিরা জবাব দেয়।
আপনার পদবী?
মিত্র।
আবার কিছুক্ষণ স্তব্ধতা। কিরীটী মনে মনে নিজেকে বোধ করি গুছিয়ে নেবার চেষ্টা করে—কি ভাবে তার আসল বক্তব্যটা এবারে সে শুরু করবে। কিন্তু তার আগে সুযোগ রুচিরাই করে দেয়। সে-ই এবারে কিরীটীর মুখের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করে, আমাকে আপনি ডেকেছিলেন কেন মিঃ রায়?
ও হ্যাঁ, বিশেষ তেমন কিছুই নয় রুচিরা দেবী। গত রাত্রের সম্পর্কে কয়েকটা কথা আপনাকে আমি জিজ্ঞেস করতে চাই, কিন্তু তার আগে আপনার—
ভ্রুকুটিপূর্ণ দৃষ্টিতে রুচিরা কিরীটীর মুখের দিকে তাকায়।
মৃদু হেসে কিরীটী বলে, আপনার মাকে বুঝি জানাননি যে ডাঃ সেনের সঙ্গে আপনার পরিচয় আছে?
কেন বলুন তো!
কথাটা জিজ্ঞাসা করলাম এইজন্য যে, মিথ্যে তাহলে আর হয়ত আপনাকে অন্যত্র উনি বিবাহের জন্য পীড়াপীড়ি করতেন না।
আমার মাকে আপনি জানেন না মিঃ রায়, কোন একটা ব্যাপারে মা একপ্রকার সিদ্ধান্ত নিলে তাঁকে সে সিদ্ধান্ত থেকে টলানো দুঃসাধ্য।
কিন্তু তাতে করে জটিলতা কি আরও বাড়ে না? যাক সে কথা, কিন্তু সমীরবাবুকে অন্ততঃ সে কথাটা জানিয়ে দিলেও হয়ত–
সেরকম বুঝলে জানাতেই হবে।
আমি বলব?
প্রয়োজন নেই। যা করবার আমিই করব।
বেশ। এবার তাহলে আমার দ্বিতীয় প্রশ্নে আসা যাক।
কিন্তু যা আমি জানতাম সবই তো দালাল সাহেবকে কাল রাত্রেই বলেছি!
বলেছেন সত্যি, তবে আরও আমার কিছু জিজ্ঞাস্য আছে।
বিস্মিত সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল রুচিরা কিরীটীর মুখের দিকে।
দেখুন মিস মিত্র, যে প্রশ্নগুলো আপনাকে আমি করব, জানবেন তার জবাবের ওপর আপনার বড়মামা রায়বাহাদুরের হত্যার ব্যাপারটা অনেকখানি নির্ভর করছে।
কি প্রশ্ন?
প্রশ্নগুলো অবশ্য কিছুটা গত রাত্রেরই পুনরুক্তি বলতে পারেন। তবু বলছি এজন্য যে কিছু কিছু ব্যাপার আরও স্পষ্ট করে আমি জানতে চাই।