অদূরে উপবিষ্ট পঞ্চাশের ঊর্ধ্বেই হবে, এক অতীব সুশ্রী ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত শ্যামকান্তি প্রৌঢ় ব্যক্তি।
প্রৌঢ়ের কাঁধের উপর দামী একখানা কাশ্মীরী শাল কাঁধ থেকে মাটিতে নেমেছে। প্রৌঢ়ের হাতে একটি কাঁচের রঙীন সুরা-ভর্তি পাত্র, পেগ গ্লাস।
যন্ত্র ও কণ্ঠের মিলিত সুরধারা যেন সুধাক্ষরণ করছিল কক্ষমধ্যে।
গায়িকার সুরেলা কণ্ঠ তখনও মিনতি করছে বারংবার : খুল খু যায় বাজুবন্দু। সুরের ধারায় সম্মোহিত সমর যেন সব কিছু ভুলে যায়।
সে যেন ভুলে যায় কেন সে এখানে এসেছে। সে যে একজন ডাক্তার এবং বিশেষ একটি রোগীর সঙ্কটময় পরিস্থিতির দরুন তাকে এই মধ্যরাত্রে ঘুম ভাঙিয়ে ডেকে আনা হয়েছে, কিছুই যেন মনে পড়ে না।
কতক্ষণ ঐ ভাবে মন্ত্রমুগ্ধের মত দাঁড়িয়ে ছিল সমর তার নিজেরও মনে নেই হঠাৎ চমকে ওঠে পিঠের ওপর যেন কার অলক্ষিত মৃদু করস্পর্শে।
চমকে তাকায় সমর সেন, তার ঠিক পিছনেই দাঁড়িয়ে থোগা ডিগডিগে এক ব্যক্তি,দৈর্ঘ্য প্রায় ছ ফুটেরও ইঞ্চিখানেক বোধ হয় বেশী হবে। যেমন দৈর্ঘ্যে সেই অনুপাতে প্রস্থে একেবারে শূন্যের কোঠায় বললেও চলে।
মাথার চুল ছোট ছোট করে কদমছাঁট করা। শকুনের মত দীর্ঘ বাঁকানো নাসিকা ও ক্ষুদ্র গোলাকার চোখ। চোখের দৃষ্টি স্থির ঘষা কাঁচের ন্যায় ফ্যাকাসে প্রাণহীন। সহসা দেখলে প্রেতের চাউনি বলেই মনে হয়।
মুখের দু পাশের হনু দুটি বিশ্রীভাবে সজাগ হয়ে আছে। দাড়ি নিখুঁতভাবে কামানো।
ডান হাতের হাড় বের করা শিরাবহুল তর্জনীটি ওষ্ঠের ওপর স্থাপন করে ইশারায় লোকটি সমরকে কথা বলতে নিষেধ জানাল এবং স্থির ঘষা কাঁচের মত ফ্যাকাসে দৃষ্টি দিয়ে যেন বলে—আমার সঙ্গে আসুন।
কতকটা যন্ত্রচালিতের মতই সমর দ্বিতীয় আর বাক্যব্যয় না করে লোকটিকে অনুসরণ করে বাইরের স্বল্পালোকিত বারান্দায় এসে দাঁড়াল।
স্প্রিং অ্যাকশনে ঘরের দরজাটা পুনরায় ততক্ষণে বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
০২. মামাকে দেখতে এসেছেন
ও ঘরে নয়। মামাকে দেখতে এসেছেন তো আপনি?
সমর কতকটা বোকার মতই যেন ঘাড় হেলিয়ে সম্মতি জানায়, হ্যাঁ—
চলুন ঐ ঘরে।
কোন মানুষের কণ্ঠস্বর এতখানি কর্কশ, চাপা ও অস্বাভাবিক হতে পারে সমরের যেন ধারণারও। অতীত ছিল।
অবাক বিস্ময়ে তখনও সমর লোকটির দিকে তাকিয়ে ছিল।
লোকটার পরিধানে পায়জামা ও গায়ে একটা কালো রঙের ভারী গ্রেট কোট।
আশ্চর্য! অমন রোগা লোকটা অতবড় একটা ভারী গ্রেট কোট কেমন করে গায়ে দিয়ে আছে।
আপনি–কি যেন বলবার চেষ্টা করে সমর।
লোকটি পূর্ববৎ কর্কশ গলায় বলে, আমি রায়বাহাদুর দুর্যোধন চৌধুরীর ভাগ্নে। আমার নাম শকুনি ঘোষ।
শকুনি ঘোষ! বিস্মিত হতভম্ব সমর পাল্টা প্রশ্নটা যেন নিজের অজ্ঞাতেই উচ্চারণ করে ফেলে।
হা হা করে লোকটা বিশ্রী কুৎসিত ভাবে একটা চাপা হাসি হেসে ওঠে। মনে হয় যেন করাত দিয়ে কেউ কাঠ চিরছে ঘ্যাস ঘ্যাস শব্দে।
আজ্ঞে, মাতুল দুর্যোধনের ভাগিনেয় শকুনি। কেন, মহাভারত পড়েননি? নামটা আবার আমার ঐ মামারই দেওয়া। চলুন–
আর দ্বিতীয় বাক্যব্যয় না করে এবারে সমর অগ্রসর হয় শকুনিকে অনুসরণ করে, একেবারে বারান্দার শেষ প্রান্তের বদ্ধ দরজাটা ঠেলে খুলতে কতকটা জড়িত চাপা কণ্ঠের একটা চিৎকার সমরের কানে এসে প্রবেশ করল, সম্পত্তি ভোগ করবে! আমার এত কষ্টের সম্পত্তি শালারা বারো ভূতে লুটে খাবে! একটি আধলা পয়সাও নয়। কোন শালাকে একটা কানাকড়িও দেব না।
সমর তখন শকুনির নীরব চোখের ইঙ্গিতে কক্ষের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে।
বড় আকারের হলঘরের মত বেশ প্রশস্ত একখানা ঘর।
ঘরের ঠিক মাঝামাঝি কালো রঙের একটা ভারী পর্দা ঝুলছিল অনেকটা পার্টিশনের মত।
পর্দার ওপাশ থেকে নীলাভ আলোর একটা দ্যুতির চাপা ইশারা পাওয়া যায়। পর্দার ওপাশ থেকেই কণ্ঠস্বরটা শোনা যায় বেশ স্পষ্ট এতক্ষণে। আর একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ডাঃ সেন ঘরের চারদিকে তাকায়। পর্দার এপাশে একটি বেশ বড় সাইজের গোলাকার টেবিলের চারপাশে খানপাঁচেক চেয়ার ও গোটা দুই সোফা, একটা সেলফ-সেলফের তিনটি তাকে নানাবিধ ওষুধপত্রের ছোট-বড় নানা আকারের শিশি, রোগীর খাবার ও ফিডিং কাপ, স্প্রে, ড়ুস-কেনিউলা প্রভৃতি সাজানো রয়েছে।
এবং ডাঃ সেনের নজরে পড়ে ঘরের দুটি সোফা অধিকার করে পাশাপাশি দুজন ভদ্রলোক বসে আছেন নিঃশব্দে। আর তাঁদের সামনে একজন দাঁড়িয়ে।
তাঁদের মধ্যে একজন মনে হয় মধ্যবয়সীই হবেন, প্যান্ট ও সাট পরিধানে, গলায় স্টেথোটি জড়ানো, উনি যে একজন চিকিৎসক বোঝা গেল। দ্বিতীয় ব্যক্তি অল্পবয়সী, তেইশ-চব্বিশের মধ্যে, পরিধানে তার ধুতি ও গায়ে একটি শাল জড়ানো।
তৃতীয় যে দাঁড়িয়ে, তার বয়স চৌত্রিশ-পয়ত্রিশের মধ্যে হবে। মাথার চুল ব্যাক-ব্রাস করা, সযত্নে।
বেশ উঁচু লম্বা চেহারা এবং অতি সুশ্রী। চোখে পুরু লেন্সের কালো সেলুলয়েডের ফ্রেমের চশমা। ভদ্রলোকের পরিধানে ধুতি ও শেরওয়ানী।
শেরওয়ানীর বোতামগুলি খোলা। দণ্ডায়মান ব্যক্তির নজরই ঘরে প্রবেশ করবার পর সর্বপ্রথম সমর ও শকুনির উপরে পড়ল। এবং কেউ কিছু বলবার আগে শকুনিই বলে তার সেই বিশ্রী গলায়, ডক্টর সেন। উপবিষ্ট দুজন সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ান বোধ হয় ডাক্তারকে অভ্যর্থনা জানাতেই। আর ঠিক ঐ সময়ে পর্দার ওপাশ থেকে আবার কণ্ঠস্বর শোনা গেল।