রায়বাহাদুরের কি? সম্ভব নয়, কারণ তাঁর হাতে বাঁধা থাকলে তিনি লকেটটা পড়ে গেলে নিশ্চয়ই জানতে পারতেন।
তবে কে?
দুঃশাসন-বৃহন্নলা-ডাঃ সমর সেন-সুলতা কর-ডাঃ সানিয়াল-অবিনাশ চৌধুরী, কেকার হাতে ছিল?
.
১১ নং পয়েন্ট : মৃত রায়বাহাদুরের ঘরে লাল সুতো বাঁধা সোনার লকেটে সুন্দরী তরুণীর প্রতিকৃতি।
টীকা: কোন ব্যর্থ প্রেমিকের গোপন প্রেমের নিদর্শন নয় তো ঐ লকেট!
১৮. মৃতদেহ ময়নাতদন্তের জন্য
মৃতদেহ ময়নাতদন্তের জন্য সিভিল সার্জনের কাছে সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে, অতএব সে কাজ শেষ হওয়ার পূর্বে সৎকারের কোন ব্যবস্থাই হতে পারে না। তথাপি আজ হোক বা কাল হোক সৎকার তো করতেই হবে। দুঃশাসন ও বৃহন্নলা সেক্রেটারি প্রাণতোষবাবু ও তহশীলদার কুণ্ডলেশ্বর শর্মার সঙ্গে নিচের মহালে বাইরের ঘরে তারই ব্যবস্থার জন্য নিম্নস্বরে আলাপ-আলোচনা করছিলেন পরস্পরের মধ্যে। মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সাধারণতঃ গৃহস্থঘরে যে স্বাভাবিক কান্নাকাটি ও শোকপ্রকাশ কয়েকটা দিন ধরে চলে অব্যাহত গতিতে তার কিছুই যেন নেই এক্ষেত্রে।
কে জানে, স্বাভাবিক মৃত্যু না হয়ে হত্যা বলেই হয়ত এই স্তব্ধতা। গত রাত্রে ব্যাপারটা জানাজানি হবার পর হতে কেউ হয়ত একফোঁটা চোখের জল ফেলেনি, কান্না তো দুরের কথা। অথচ স্বাভাবিক ভাবে সকলেরই হয়ত শোক করা কর্তব্য ছিল।
শোক নেই তবু যেন বাড়ির মধ্যে সর্বত্র একটা শ্বাসরোধকারী বিষণ্ণতা থমথম করে। সবাই। যেন কেমন ভীতসন্ত্রস্ত।
সকলেই যেন কান পেতে আছে একটা কিছু শোনবার জন্যে, অবশ্যম্ভাবী একটি পরিণতির আশঙ্কায় প্রত্যেকেই যেন শঙ্কিত, ব্যাকুল হয়ে প্রহর গুনছে।
নিহত হবার আগে রোগশয্যায় শুয়ে অসুস্থ রায়বাহাদুর গত কয়েকদিন ধরে বলতে গেলে দিবারাত্র যে দুঃস্বপ্ন দেখছিলেন জাগ্রত ও নিদ্রিত সকল অবস্থাতেই, সেই দুঃস্বপ্নেরই অশরীরী প্ৰেতটা যেন এখন এ বাড়ির প্রত্যেকের মনের উপর চেপে বসেছে। যেন সকলকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে।
.
শ্রীনিলয়ের পেটা ঘড়িতে ঢং ঢং করে বেলা দুটো ঘোষণা করে।
কিরীটী তার নির্দিষ্ট ঘরের মধ্যে ডাঃ সানিয়ালের সঙ্গে মুখোমুখি বসে কথা বলছিল। একটু আগে সে দালাল সাহেবের প্রেরিত অনুচরের মুখে সংবাদ পেয়েছে পলাতক শকুনি ঘোষ শেষ পর্যন্ত পুলিসের চোখ এড়িয়ে বেশীদূর পালাবার আগেই ধরা পড়েছে ও তাকে থানায় নিয়ে গিয়েছে।
ধরেছেন তাকে অবশ্য দালাল সাহেব নিজেই। কিছুদূরে একটা কোলিয়ারীতে জরুরী একটা তদন্তে নিজের গাড়িতে করে দালাল সাহেব যাচ্ছিলেন, এমন সময় পথের মধ্যে একেবারে দুখানা গাড়ি দুইদিক হতে মুখোমুখি হওয়ায় শকুনি ঘোষের অবস্থাটা সঙ্গীন হয়ে ওঠে এবং একপ্রকার বাধ্য হয়েই দালাল সাহেবের পূর্ব নির্দেশকে অমান্য করে স্থানত্যাগ করবার অপরাধে ধৃত হয়ে সরাসরি একেবারে সশস্ত্র প্রহরীর হেপাজতে হাজতে প্রেরিত হয়েছে। সংবাদটা অবশ্য একমাত্র কিরীটী ও ডাঃ সানিয়াল ব্যতীত এ বাড়ির একটি প্রাণীও জানে না বা কাউকে জানতে দেওয়া হয়নি।
কিছুক্ষণ পূর্বে কিরীটী ও ডাঃ সানিয়ালের মধ্যে শকুনি ঘোষ সম্পর্কেই কথা হচ্ছিল। তবে কি শকুনিবাবুই অপরাধী মিঃ রায়? প্রশ্ন করেন ডাঃ সানিয়াল।
মনে মনেও অন্ততঃ তিনি কিছুটা অপরাধী বৈকি। নচেৎ ওভাবে হঠাৎ তিনি পালাবার চেষ্টাই বা করবেন কেন? কিরীটী মৃদু হেসে জবাব দেয়।
আপনার কি সত্যিই মনে হয় স্পষ্ট করে বলুন মিঃ রায়। আপনার ধারণা কি তাহলে শকুনি ঘোষই কাল রাত্রে—কথাটা বলে ব্যগ্র দৃষ্টিতে তাকালেন ডাঃ সানিয়াল কিরীটীর মুখের দিকে।
প্রশ্নটা আপনার বড় direct ডাক্তার, এক্ষেত্রে অবিশ্যি সত্যিকারের সংবাদটা গোপন করে যাওয়াটাও একটা মস্তবড় অপরাধ। তাছাড়া এমনও তো হতে পারে, নিজের হাতে হত্যা
করলেও উনি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে হত্যাকারীকে সাহায্য করেছেন। বিচারের দৃষ্টিতে ও আইনে murder ও abetment of murder—দুটো charge কি একই পর্যায়ে পড়ে না?
তবে কি–
ক্ষমা করবেন, অত স্পষ্ট করে কিছুই আমি বলতে চাই না ডাক্তার, তবে শকুনি ঘোষ যে নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিয়েছেন একথাও আমি বলব, তাছাড়া এটা হয়ত তাঁর জানা ছিল না, বাঘে একবার কামড়ালে আঠারো জায়গায় ঘা হয়। ও বড় মারাত্মক ছোঁয়া। বলতে বলতে হঠাৎ প্রসঙ্গান্তরে উপস্থিত হয়ে কিরীটী ডাক্তারের চোখে চোখ রেখে বলে, কিন্তু আপনাকেও যে আমার কয়েকটা কথা জিজ্ঞাস্য ছিল ডাক্তার!
আমাকে?
হ্যাঁ।
কি বলুন তো?
অবশ্য কথাটা সম্পূর্ণই আমার ও আপনার মধ্যেই আবদ্ধ থাকবে, কোন তৃতীয় ব্যক্তি জানতে পারবে না।
বলুন না কি জানতে চান মিঃ রায়।
কথাটা সুলতা কর সম্পর্কে।
সুলতা!
কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গেই ডাঃ সানিয়ালের মুখখানা যেন রক্তিম হয়ে ওঠে। আপনা হতেই দুচোখের দৃষ্টি নত হয়ে আসে ডাক্তারের।
কিরীটী মনে মনে না হেসে পারে না। এবং কৌতুকের লোভটাও সম্বরণ করতে পারে না।
স্মিত কণ্ঠে বলে, ডাক্তার, মনের খোঁজ নিয়ে মন দিয়েছিলেন তো?
লাজরক্তিম মুখটা তুলে ডাক্তার বলেন, যাঃ, কি যে বলেন মিঃ রায়! Simply I liked that girl, বেশ মেয়েটি!
সে বিষয়ে আমিও নিঃসন্দেহ, তবু বলব মনটা দেবার আগে বোধহয় একটু যাচাই করে নিলে পারতেন।