তারপর আবার একসময় পায়চারি থামিয়ে অবিনাশ চৌধুরী বলেন, মৃত্যুর পরে ঐসব প্রেতলোকটোক আপনি মানেন রায় মশাই?
হিন্দুর ছেলে যখন তখন চিরন্তন সংস্কারকে একেবারে এড়াব কেমন করে বলুন!
বিশ্বাস করেন তাহলে?
কিরীটী প্রত্যুত্তরে মৃদু হাসে।
এই যে সব লোকে বলে অতৃপ্ত বাসনা বা কামনা নিয়ে মরলে বায়বীয় সত্তা সেই বাসনা বা কামনার জন্য এই পৃথিবীতে ফিরে ফিরে আসে, বিশ্বাস করেন এসব কথা?
কিরীটী অবিনাশ চৌধুরীর মুখের দিকে অতঃপর না তাকিয়ে পারে না। বিশেষ করে অবিনাশ চৌধুরীর কণ্ঠস্বর শুনে। অবিনাশ চৌধুরীর মুখের দিকে চেয়ে হঠাৎ যেন ওর মনে হয় একটা অলিখিত ভয় ও শঙ্কা যেন সে মুখের রেখায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কিন্তু কেন?
অবিনাশ চৌধুরী অতঃপর ঘুরে দাঁড়িয়ে দেয়ালে প্রলম্বিত একখানি নিজেরই ছবির দিকে। একদৃষ্টে চেয়ে যেন কি দেখতে লাগলেন। আর একটি কথাও কিরীটীর সঙ্গে বললেন না।
কিরীটী কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু অবিনাশ চৌধুরী পূর্ববৎ পায়চারি করতে লাগলেন।
কিরীটী ঘর হতে বের হয়ে আসবার জন্য অতঃপর দুয়ারের দিকে পা বাড়ায়।
.
কিরীটী অবিনাশ চৌধুরীর ঘর থেকে বের হয়ে কি ভেবে আবার রায়বাহাদুর দুর্যোধনের ঘরের দিকে অগ্রসর হয় এবং ঢুকতেই হঠাৎ মেঝেতে রায়বাহাদুরের শূন্য খাটটার নীচে কি একটা বস্তু চিকচিক করছে তার নজরে পড়ে। কৌতূহলে এগিয়ে গিয়ে তুলে নেয় নীচু হয়ে বস্তুটি। একটা লাল সূতোয় বাঁধা সোনার লকেট। লকেটটা খুলতেই ভেতর থেকে প্রকাশ পেল অপরূপ সুন্দরী একটি তরুণীর মুখচ্ছবি। কে? কার ফটো?
১৭. অবিনাশ পায়চারি করছেন
অবিনাশ পায়চারি করছেন আর মৃদুকণ্ঠে আবৃত্তি করে চলেছেন—
নির্মম নিয়তি। অন্তিম সময়ে
একি মহা বিস্মরণ! গুরুদেব!
গুরুদেব!–ক্ষমা কর। ক্ষমা
কর প্রভু। অস্ত্র আবাহন মন্ত্র
দাও প্রভু ফিরাইয়া মোরে।
নিঃশব্দে ঘরের দরজাটা খুলে গেল এবং ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলেন গান্ধারী দেবী।
কাকামণি!
কে? ফিরে তাকালেন সঙ্গে সঙ্গে অবিনাশ চৌধুরী।
আমি গান্ধারী।
আয় মা। দুর্যোধন—দুর্যোধনকে কি ওরা নিয়ে গেল?
হ্যাঁ। এই আধঘণ্টাটাক আগে পুলিসের লোক এসে মৃতদেহ নিয়ে গেছে।
অভিশাপ—বুঝলি মা, এ সুরমার অভিশাপ!
সতী নারী দেছে অভিশাপ।
তীব্র নিরাশায় কেটে যাবে দিন
সহস্র বান্ধব মাঝে রহিব একাকী–
আমার মনের ব্যথা কেহ বুঝিবে না,
কণ্টক হইবে শয্যা—
কাঁদতে পারছি না মা—আমি কাঁদতে পারছি না। সুরমাই আমার সমস্ত চোখের জল মুছে নিয়ে গিয়েছে।
একটু থেমে অবিনাশ চৌধুরী আবার বলতে থাকেন, চার বছর আগে এই বাড়ি থেকে যেদিন সুরমার মৃতদেহটা পালঙ্কের ওপর থেকে নিয়ে ওরা বের হয়ে গেল, সেই দিন—সেই দিনই এ-বাড়ির সমস্ত ঐশ্বর্য বিদায় নিয়েছিল চিরদিনের মতই। একটা দিনের জন্য তাকে শান্তি দেয়নি ওই দুযযাধন। টাকা—টাকাই কেবল চিনেছিল। কিন্তু পারলি নিয়ে যেতে সঙ্গে সেই টাকা? একটা পয়সা নিয়ে যেতে পারলি? এত চিকিৎসা, এত আয়োজন সবই মিথ্যে হয়ে গেল তো?
আপন মনেই এবং আপন খেয়ালেই যেন অবিনাশ কথাগুলো বলে যান। গান্ধারী নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে কথাগুলো শুনতে থাকে।
মেজাজী ও অত্যন্ত খেয়ালী প্রকৃতির খুল্লতাতকে গান্ধারী দেবী বেশ ভাল করেই চেনেন। নিজের চলার পথে আজ পর্যন্ত এতটুকু বাধাও অবিনাশ কখনও সহ্য করেননি। কারও উপদেশ বা পরামর্শকে কোনদিন গ্রহণ করেননি। নিজের বিচারবুদ্ধিতে চিরদিন যা ভাল বুঝেছেন তাই করেছেন। তাঁর কথার মধ্যে কোনরূপ মন্তব্য প্রকাশ করলে বা কথা বললে মুহূর্তে যে তিনি বারুদের মত জ্বলে উঠবেন গান্ধারী দেবী তা ভাল করেই জানেন। তাই বোধ হয় নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকেন গান্ধারী দেবী।
কথাগুলো বলে অবিনাশ আবার আপন মনেই ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে লাগলেন নিঃশব্দে। তারপর হঠাৎ একসময় যেন অদূরে নিঃশব্দে দণ্ডায়মান গান্ধারী দেবীর প্রতি দৃষ্টিপাত করে বলে ওঠেন, গান্ধারী, তুই আবার এখানে হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? কি চাস?
একটা কথা বলতে এসেছিলাম কাকামণি!
কি বলবি বলে ফেল! হাঁ করে দাঁড়িয়ে থেকে লাভ কি?
আশ্চর্য, এ যেন সম্পূর্ণ অন্য এক মানুষ।
একটা বিশ্রী ব্যাপার ঘটে গেছে কাকামণি—
কি–কি হয়েছে?
বলছিলাম, শকুনি পালিয়েছে–
শকুনি পালিয়েছে! সে কি? হঠাৎ সে হতভাগাটা আবার পালাতেগেল কেন? কিন্তু তুই-তুই সে কথা জানলি কি করে?
এই কিছুক্ষণ আগে কৈরালা এসে প্রসাদকে বলেছে কথাটা। প্রসাদ আমাকে বলে গেল। বৃহন্নলার টু-সিটার গাড়িটা নিয়ে সে পালিয়েছে।
ইডিয়েট! গর্দভ!
কিন্তু তার পালানো ছাড়া আর উপায়ই বা ছিল কি?
মাথামুণ্ডু কি বলছিস তুই?
উত্তরে গান্ধারী দেবী কিছুক্ষণ নিঃশব্দে চুপচাপ দাঁড়িয়েই থাকেন।
অবিনাশ খিঁচিয়ে ওঠেন, জবাব দিচ্ছিস না কেন? বল না, হঠাৎ সে গর্দভটা পালাতেই বা গেল কেন?
কাল রাত্রে—গান্ধারী ইতস্ততঃ করতে থাকেন।
কি–কাল রাত্রে কি? উত্তেজিত ব্যাকুল কণ্ঠে প্রশ্ন করেন অবিনাশ।
কাল রাত্রে তখন বোধ করি রাত পৌনে চারটে হবে, ওর পাশের ঘরের লাগোয়াই তো আমার শোবার ঘর, একটা ছপছপ জলে কাপড় কাচার শব্দ শুনে সন্দেহ হওয়ায় আমার ঘরের লাগোয়া যে পেছনের বারান্দা আছে সেই বারান্দা দিয়ে ওর ঘরে বন্ধ জানলার কপাটের খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখি—