এক সময় ধীরে ধীরে অবিনাশ চৌধুরী বলতে শুরু করলেন, কি জানেন রায় মশাই, সবই দুভাগ্য। নচেৎ বয়েস হয়েছে আমার, যাবার কথা তো আমারই। কিন্তু চলে গেল দুর্যোধন। অবিশ্যি আপনারা বলবেন সে তো অসুস্থ ছিলই। তা ছিল—ঐ ভাবে না মরে যদি সে অসুখেই মারা যেত, তবে তো দুঃখটা এত হত না। এত painful হত না ব্যাপারটা। ওরা তো জানে না, এই বিরাট কোলিয়ারীর বিজনেস দুজনে মিলে আমরা গায়ের রক্ত জল করে দিনের পর দিন, রাত্রির পর রাত্রি অক্লান্ত পরিশ্রমে তিল তিল করে কি ভাবে গড়ে তুলেছিলাম! এই মাত্র বছর দুই হল কাজ থেকে অবসর নিয়ে একটু বিশ্রাম নিচ্ছি। দুযযাধন যে আমার কতখানি ছিল, ভাইপো হলেও সে আমার বন্ধু বলতে বন্ধু, সুহৃদ, পরামর্শদাতা, সঙ্গী সাথী—একাধারে সে-ই আমার সব ছিল। দুযযাধনই ছিল এ গোষ্ঠীর মধ্যে মানুষের মত মানুষ। নচেৎ এই চৌধুরী-বাড়িতে আর মানুষ বলতে একটা প্রাণীও আছে নাকি? ওর একমাত্র ছেলে ঐ বৃহন্নলা, ওটা তো মেয়েমানুষের অধম-effiminate, মেরুদণ্ডহীন। একমাত্র ঐ ভাই দুঃশাসন, ওটার কিছু বুদ্ধি ছিল; কিন্তু ওটার মাথায়ও পোকা আছে।
পোকা আছে! কিরীটী প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকায় অবিনাশ চৌধুরীর মুখের দিকে।
তা নয় তো কি? নইলে ও হতভাগাটার মধ্যেও পার্টস ছিল। এককালে চমৎকার গান-বাজনার শখ ছিল। কিন্তু সব গোল্লায় দিয়ে বসে আছে।
কেন, এখন আর গান-বাজনার শখ নেই বুঝি?
না, এখন কেবল এক নেশা হয়েছেটাকা, টাকা আর টাকা! দিবারাত্র কেবল ফন্দিফিকির আঁটছে কিসে টাকা আসবে!
আচ্ছা শুনছিলাম মৌচীতে বিজনেসে নাকি বেশ টাকা উনি রোজগার করছিলেন, তবে চলে এলেন কেন হঠাৎ?
বেশ টাকা রোজগার করছিল না ঘোড়ার ডিম! সেখানকার ব্যবসা নষ্ট করে এখন এখানে বসে সব লণ্ডভণ্ড করবে এই মতলব। মরুক গে। দুর্যোধন গেল। আমিও আর কটা দিনই বা! থাকলে ওর আর বৃহন্নলারই থাকত। বৃহন্নলাটা একটা হস্তীমূখ। এখন সুবিধেই হল, দুদিনে সব তছনছ করে দেবে।
কিন্তু গতরাত্রে আপনি তো বলছিলেন রায়বাহাদুরের উইল আছে—
উইল! হ্যাঁ, উইল একটা আছে। আর আমি জানি সে উইলে একটা কপর্দকও কারও নষ্ট করার ক্ষমতা নেই এমন ভাবেই ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু সাত-সাতটা কোলিয়ারীর দেখাশোনা করবে কে? কাঁচা পয়সা কোলিয়ারীতে। ওরা কাকা-ভাইপোই তো দেখবে সব। দিনের আলোয় পুকুরচুরি হলেই বা ঠেকাচ্ছে কে?
আচ্ছা উইলটা কি রেজেস্ট্রি করা আছে?
তা জানি না, সংবাদ রাখি না।
আচ্ছা কাকা সাহেব, রায়বাহাদুর যে নিহত হবেন গত রাত্রে রাত চারটের সময়, এই বদ্ধমূল ধারণাটা তাঁর কেন হয়েছিল বলতে পারেন কিছু? কোন কারণ ছিল কি?
কিরীটীর প্রশ্নে অবিনাশ চৌধুরী কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন, কোন জবাবই দেন না।
তারপর শান্ত কণ্ঠে বললেন, না। বলতে পারি না।
আর একটা কথা। গতরাত্রে কে আপনাকে রায়বাহাদুরের নিহত হবার সংবাদটা দেয়?
প্রসাদই তো দেয়।
প্রসাদ!
হ্যাঁ।
কাল রাত সাড়ে তিনটে থেকে রায়বাহাদুরের নিহত হবার সংবাদ পাওয়া পর্যন্ত আপনি কোথায় ছিলেন?
রাত তিনটে নাগাদ বাঈজী চলে যায়। তারপর পাশের ঘরে আমি শুতে যাই। কিন্তু ঘুম আসছিল না বলে বিছানায় শুয়ে শুয়ে বই পড়ছিলাম।
প্রসাদ ঠিক কটায় আপনাকে সংবাদ দিতে এসেছিল জানেন? মনে আছে আপনার?
রাত তখন প্রায় সাড়ে চারটে হবে বোধ হয়।
তখন কি আপনি ঘুমিয়ে ছিলেন?
ঠিক ঘুম নয়, বোধ হয় একটু তন্দ্রামত এসেছিল, এমন সময় প্রসাদ এসে ডাকতেই—
ও-ঘর থেকে ফিরে এসে আপনি বোধ হয় আর শুতে যাননি?
না। মনটা এমন অস্থির লাগতে লাগল দুযযাধনকে ঐভাবে নিহত হতে দেখে যে বাধ্য হয়ে মুন্নাকে এ-ঘরে তখুনি আবার ডেকে পাঠালাম? মুন্নাও অবাক হয়ে গিয়েছিল। ঘণ্টাখানেক আগে মাত্র তাকে রাত্রির মত বিদায় দিয়েছিলাম।
মুন্নাবাঈ তখনও জেগেই ছিলেন?
হ্যাঁ। ও এসে বললে, অনেক রাত পর্যন্ত জেগে ও নিজেও বিছানায় শুয়ে ছটফট করছিল। আমার চাকর গিয়ে ডাকতেই উঠে এসেছিল।
হঠাৎ এমন সময় দেওয়াল ঘড়িটায় ঢং ঢং করে বেলা এগারটার সময়-সঙ্কেত শোনা গেল।
ঘড়ির সময়-সঙ্কেতে কিরীটীর খেয়াল হল অনেকক্ষণ সে ঐ ঘরে আছে। বলে, আচ্ছা অনেক বেলা হয়ে গেল, আর আপনাকে বিরক্ত করব না কাকা সাহেব।
কাকা সাহেবও যেন কিরীটীর কথায় চমকে ওঠেন। এবং অকস্মাৎ একটা প্রশ্ন করে বসেন, আচ্ছা রায় মশাই, দুযযাধনের মৃতদেহটা কি ওরা এখান থেকে নিয়ে গিয়েছে? প্রশ্নটা করে কিরীটীর মুখের দিকে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণের জন্য অবিনাশ চৌধুরী।
হ্যাঁ, ময়নাতদন্তের জন্য পুলিস মৃতদেহ নিয়ে গিয়েছে।
সৎকার হবে না?
ময়নাতদন্ত হয়ে গেলেই আপনারা সৎকারের ব্যবস্থা করতে পারবেন। কিরীটী মৃদুকণ্ঠে প্রত্যুত্তর দেয়।
তার আয়োজন কিছু ওরা করেছে জানেন?
আমি এখুনি গিয়ে বৃহন্নলা ও দুঃশাসন চৌধুরীর কাছে সংবাদ নিচ্ছি।
দয়া করে ওদের বলে দেবেন, আমাকে যেন ওর মধ্যে আর না টানে। আর একটা কথা বলে দেবেন, অস্থিটা যেন গঙ্গায় ফেলার ব্যবস্থা করা হয়।
বলব।
দুঃখ যেমন দিয়েছে তেমনি নিজেও দুঃখ কম পায়নি। দিক, অস্থিটা গঙ্গাতেই বিসর্জন দিক। তবু যদি মরার পর গিয়ে শান্তি পায়।
কথাগুলো বলে অবিনাশ চৌধুরী যেন হঠাৎ আবার কেমন অন্যমনস্ক হয়ে যান। এবং নিঃশব্দে ঘরের মধ্যে আবার পায়চারি শুরু করেন।