ঘরের চারিদিকে দৃষ্টিপাত করতে করতে সহসা তার দৃষ্টি দেওয়ালের গায়ে টাঙানো কতকগুলো ফটো ও চিত্রের প্রতি আকৃষ্ট হয়।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতেই কিরীটী ফটো ও চিত্রগুলো দেখতে থাকে।
চিত্রগুলো সব বিখ্যাত অভিনেতা ও অভিনেত্রীদের।
নাট্যাচার্য গিরিশ ঘোষ, দানীবাবু, অর্ধেন্দু মুস্তফী, শিশির ভাদুড়ী, কৃষ্ণভামিনী, তারাসুন্দরী, বিনোদিনী, কুসুমকুমারী প্রভৃতির। আর সেই সঙ্গে কয়েকটি ফটো—বিখ্যাত সব নাটকের কয়েকটি বিখ্যাত চরিত্রের রূপসজ্জায়। সাজাহানের ঔরংজীব, প্রফুল্লর রমেশ, চন্দ্রগুপ্তের চাণক্য, প্রতাপাদিনের ভবানন্দ ইত্যাদি।
একসময় কিরীটীর অভিনয় দেখবার প্রচণ্ড নেশা ছিল ছাত্রজীবনে। এক গিরিশ ঘোষ ও সেই সময়কার দু-একজন ব্যতীত প্রায় সব নামকরা অভিনেতা-অভিনেত্রীদেরই সে প্রায় চেনে। কিন্তু বিশেষ ঐ বিভিন্ন রূপে সজ্জিত অভিনেতাটিকে তো কখনও ইতিপূর্বে কোন নাট্যালয়ে দেখেছে বলে কই স্মরণ করতে পারছে না!
হঠাৎ একটি ফটোর সামনে কৌতূহলভরেইসে এগিয়ে গেল। ঔরংজীবের রূপসজ্জায় ফটোটি।
মুখটা বিশেষ করে চোখ দুটি চেনা-চেনা বলে মনে হচ্ছে যেন। কে ঐ অভিনেতা? কে?
সহসা যেন বিদ্যুৎ-চমকের মতই মানসপটে একটা সম্ভাবনা উঁকি দিয়ে যায়।
তবে কি—
সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে দাঁড়ায় কিরীটী। এবং ঘুরে দাঁড়াতেই অবিনাশ চৌধুরীর কৌতূহলী দৃষ্টির সঙ্গে তার দৃষ্টি-বিনিময় হয়।
কি দেখছেন মিঃ রায়! অবিনাশ চৌধুরী প্রশ্ন করেন।
আপনারই রূপসজ্জার ফটো বোধ হয় এগুলো? প্রশ্ন করে কিরীটী।
এতক্ষণ ধরে ঘরের মধ্যে যার উপস্থিতিকে অবিনাশ চৌধুরী ভ্রুক্ষেপমাত্রও করেননি—ফিরে তাকাননি পর্যন্ত তার দিকে, কিরীটীর ঐ শেষের প্রশ্নে সেই অবিনাশ চৌধুরী যেন সচকিতে মুখ তুলে তাকালেন ওর দিকে এবং এতক্ষণের মৌনতা ও বিরক্তি যেন সহসা মুহূর্তে এক নির্মল স্নিগ্ধ কৌতুক হাসিতে রূপান্তরিত হল।
স্নিগ্ধ প্রসন্ন কণ্ঠে চৌধুরী বললেন, হ্যাঁ। এককালে আমার ঐ থিয়েটার করা একটা প্রচণ্ড নেশা ছিল রায় মশায়—বলতে বলতে সহসা উপবিষ্ট অবিনাশ গালিচা ছেড়ে উঠে কিরীটীর। একেবারে পাশটিতে এসে দাঁড়ালেন।
আপনি কখনও পাবলিক স্টেজে অভিনয় করেছেন?
না। সাধারণ রঙ্গমঞ্চে পেশাদারী ভাবে অভিনয় আমার ধাতে ঠিক খাপ খেত না রায় মশাই। স্টেজ ও অভিনয়ের ব্যাপারে আমার যেমন আগ্রহ কৌতূহল ও নিষ্ঠার অভাব ছিল না তেমনি অর্থব্যয়ও কম করিনি। শুধু আমাদের দেশেই নয়, ওদের দেশের অভিনয়, অভিনেতা ও ওখানকার রঙ্গমঞ্চ সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করবার জন্য ওদের দেশেও গিয়েছি এবং জীবনে এক সময় অভিনয়কেই পেশা বলে গ্রহণ করব ভেবেছিলাম। কিন্তু আপনি হয়ত জানেন না রায় মশাই, এদেশের অভিনয়শিল্পের সঙ্গে যে সব পুরুষ ও নারী সংশ্লিষ্ট, বলতে গেলে তাদের মধ্যে সকলেরই প্রায় অত বড় একটা শিল্পের প্রতি যে নিষ্ঠা ও শ্রদ্ধা থাকা দরকার তার বিন্দুমাত্রও আদৌ নেই। সেই জন্যই শেষ পর্যন্ত রঙ্গমঞ্চ ও অভিনয়কে ত্যাগ করে আসতে বাধ্য হয়েছিলাম আমি।
দোষটা হয়ত এক পক্ষেরই নয় চৌধুরী মশায়। কিরীটী মৃদু হেসে বলে, জনসাধারণের কাছ থেকেই বা অভিনেতা ও অভিনেত্রীরা কতটুকু সম্মান পেয়ে থাকেন আমাদের দেশে বলুন!
শ্রদ্ধা আকর্ষণ করতে হয়, অর্জন করতে হয় মিঃ রায়। ভিক্ষুকের মত হাত পেতে তা মেলে না।
কিরীটী ও অবিনাশ চৌধুরীর কথাবার্তায় আকৃষ্ট হয়ে ইতিমধ্যে কখন এক সময় বাঈজী গুনগুন করে কণ্ঠে যে তাল তুলেছিল সেটা মাঝপথেই থামিয়ে দিয়ে কখন এক সময় ওদের কথাবার্তায় কান দিয়েছিল। কেবল মধ্যে মধ্যে অন্যমনস্কভাবে ক্রোড়স্থিত বীণার তারে মৃদু মৃদু অঙ্গুলি সঞ্চালন করছিল।
মধ্যে মধ্যে রিনঝিন একটা মিষ্টি তারের আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল।
অবিনাশ চৌধুরী যেন কিরীটীর প্রতি সহসা অত্যন্ত প্রসন্ন হয়ে ওঠেন।
অবিনাশ ও কিরীটী অভিনয়-সংক্রান্ত আলাপ-আলোচনায় এতটা তন্ময় হয়ে ওঠে যে, বাঈজী যে একপ্রকার বাধ্য হয়েই একসময় ক্রোড়স্থিত বীণাটি গালিচার ওপরে নিঃশব্দে নামিয়ে রেখে ঘর থেকে বের হয়ে গেল অবিনাশ চৌধুরীরও যেন সেটা নজরেই পড়ে না।
কিরীটী অবিনাশ চৌধুরীর সঙ্গে আলোচনায় নিবিষ্ট থাকলেও, তার মনের সক্রিয় অংশটা কিন্তু সুযোগের অপেক্ষায় ছিল—কখন কোন ফাঁকে সে তার আসল বক্তব্যের মধ্যে প্রবেশ করবে!
সুযোগ করে দিলেন অবিনাশ চৌধুরী নিজেই। সহসা তিনিই কিরীটীকে প্রশ্ন করলেন, আপনার কি যেন প্রয়োজন ছিল আমার কাছে রায় মশাই, আপনি বলছিলেন—
না না থাক, সে অন্য সময় হবেখন।
উঁহু! স্বর্ণলঙ্কাধিপতি রাবণের খেদোক্তি শোনেননি, আজ নয় কাল এই করে করে স্বর্গের সিঁড়ি শেষ পর্যন্ত তাঁর তৈরী করাই হল না। বলুন, out with it!
বিশেষ তেমন কিছু না। আপনি তো জানেন, মৃত্যুভয়ে ভীত হয়েই রায়বাহাদুর আমাকে এখানে আনিয়েছিলেন! এখন যদি তাঁর হত্যাকারীকে—
কথাটা কিরীটী শেষ না করেই থেমে গেল এবং সঙ্কোচের সঙ্গে অবিনাশ চৌধুরীর মুখের দিকে তাকায়।
অবিনাশ চৌধুরীও যেন হঠাৎ ঐ কথায় কেমন কিছুক্ষণের জন্যে গুম হয়ে থাকেন। শুধু তাই নয়, কিরীটীর মনে হয় অবিনাশ চৌধুরী কেমন যেন একটু চিন্তিত তাঁর প্রশস্ত উন্নত ললাটে কয়েকটা চিন্তার রেখা জেগে উঠেছে।