একটা কথা, আশা করি কিছু মনে করবেন না বৃহন্নলাবাবু, আপনার কাকার বর্তমান আর্থিক অবস্থাটা কেমন বলতে পারেন?
সঠিক আমি জানি না, তবে নগদ টাকা বেশ কিছু তাঁর হাতে আছে বলেই আমার তো ধারণা।
কেন আপনার এ ধারণা—বলতে আপনার আপত্তি আছে কি কিছু?
এখানে এসে অবধিই তিনি আমাকে প্রায়ই বলেছেন কোডামতে আবার তিনি মাইকার বিজনেস বড় করেই শুরু করবেন। ইতিমধ্যে দুএকবার কোমায় গিয়ে ঘুরেও এসেছেন।
আচ্ছা আপনি আপনার পিতার হত্যার ব্যাপারে কাউকে সন্দেহ করেন কি?
না। ধীর সংহত কণ্ঠে জবাব দিলেন বৃহন্নলা চৌধুরী।
আপনি এবারে যেতে পারেন মিঃ চৌধুরী। আপনার দাদু অবিনাশবাবুকে যদি এ ঘরে একবার দেখা করতে আসতে বলি, আসবেন কি?
যদি মনে কিছু না করেন মিঃ রায়, আমার মনে হয় যদি তাঁকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে চান তাহলে তাঁর ঘরে গেলেই বোধ হয় ভাল হয়, কারণ তাঁকে ডাকলে যে তিনি আসবেন আমার তো মনে হয় না।
ডাঃ সানিয়ালের ঘর থেকে বের হয়ে ডাঃ সমর সেন কতকটা অন্যমনস্ক ভাবেই সিঁড়ির দিকে অগ্রসর হন। কিন্তু অন্যমনস্ক ভাবে—সিঁড়ি যেখানে বাঁক নিয়েছে, সেখানে এসে পৌঁছতেই যেন হঠাৎ চমকে ওঠেন।
ঠিক সামনেই তাঁর দাঁড়িয়ে রুচিরা। বোধ হয় নীচে গিয়েছিল। সেই সময় সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে আসছিল।
রুচিরা!
রুচিরা ডাঃ সেনের ডাকে মুখ তুলে তাঁর দিকে তাকায় একটু যেন চমকেই।
তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা ছিল রুচিরা।
নীচে বাইরের ঘরে এস।
চল।
রুচিরাকেই অতঃপর অনুসরণ করে ডাঃ সেন পূর্বরাত্রের সেই নীচেকার বিরাট খালি ঘরটার মধ্যে গিয়ে প্রবেশ করলেন।
কাল রাত্রে দেখা গিয়েছিল ঘরের জানলা-দরজাগুলো বন্ধ, কিন্তু আজ দেখা গেল জানলাগুলো খোলা। একটা খোলা জানালার সামনে দুজন এসে দাঁড়ায়।
রুচিরাই প্রথমে কথা বলে মৃদু হেসে, তোমাকে কাল রাত্রে বাড়িতে দেখেও কেন না চেনবার ভান করেছি তাই জিজ্ঞাসা করবে তো?
হ্যাঁ, তাছাড়া—
তাছাড়া আবার কি?
তাছাড়া সমীরবাবুর সঙ্গে যে অলরেডি তোমার বিয়ের সম্বন্ধ ঠিক হয়ে গেছে সেইটাই বা এতদিন জানাওনি কেন?
রুচিরা ডাঃ সেনের কথার জবাব দেয় না। চুপ করেই থাকে।
ডাঃ সেন আবার বলেন, এইজন্যই যে এতদিন বার বার তোমার কাছে প্রোপোজ করা সত্ত্বেও আমায় কোন জবাব দাওনি তাও বুঝলাম, কিন্তু এর তো কোন প্রয়োজন ছিল না। রুচিরা!
রুচিরা তথাপি চুপ।
কি, জবাব দিচ্ছ না যে?
যে জবাবই এখন দিই না কেন, তুমি তো বিশ্বাস করবে না সমর।
বিশ্বাস করব না!
না। তারপর একটু থেমে আবার বলে, কার কাছে তুমি কি শুনেছ তা জানি না, তবে আমি ভেবেছিলাম তুমি অন্ততঃ আমাকে এতদিনে বুঝতে পেরেছ।
হ্যাঁ, বুঝেছি বৈকি। বড়লোক স্বামীর লোভ তুমি ছাড়তে পারনি বলেই গরীব আমাকে নিয়ে তুমি এতদিন ধরে খেলা খেলছ!
সমর!
হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাই। কিন্তু এর কি প্রয়োজন ছিল বলতে পার রুচিরা দেবী?
তোমার আর কোন কথা যদি না থাকে তো এবারে আমি যাব!
যাবে বৈকি। খেলাটা যখন জানতে পেরে গেছি–
সমর সেনের কথাটা শেষ হল না, ঘরের মধ্যে কিরীটীর গলা শোনা গেল, সমরবাবু!
দুজনেই চমকে অদূরে উপস্থিত কিরীটীর দিকে তাকায়। কিরীটী যে ইতিমধ্যে নিজের ঘর থেকে বেরুবার মুখে সিঁড়ির সামনে ওদের দূর থেকে দেখে একেবারে কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে ওদের কথাগুলো শুনেছে সেটা দুজনের একজনও টের পায়নি।
কিরীটী অতঃপর বলল, আপনারা দুজনেই একটু ভুল বুঝেছেন দুজনকে। ডাঃ সেন, আপনার এটা অন্ততঃ বোঝা উচিত ছিল যে রুচিরা দেবীর মা এখানে বর্তমান!
আমি জানি তা মিঃ রায়, ডাক্তার সেন বললেন।
কিরীটী আবার যেন কি বলতে যাচ্ছিল, এবার রুচিরা বাধা দিল, মিঃ রায়!
না রুচিরা দেবী, মিথ্যে মনগড়া মনোমালিন্যের বোঝ টেনে লাভ নেই। শুনুন ডাঃ সেন, ওঁর মা সমীরবাবুর সঙ্গে ওঁর বিয়ের সব কথাবাতা ঠিক করলেও ওঁর মত পাননি–বলেই হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে মৃদু হেসে বলে, ঝগড়াটা তাহলে এবার মিটিয়ে ফেলুন, আমি চলি।
কিরীটী স্থানত্যাগ করে।
১৫. অবিনাশ চৌধুরীর ঘরের দরজা
অবিনাশ চৌধুরীর ঘরের দরজা ভেতর হতে ভেজানোই ছিল।
দরজার গায়ে মৃদু করাঘাত করে কিরীটী। ভেতর হতে সুমিষ্ট শান্ত গলায় প্রশ্ন আসে, কে?
আমি কিরীটী।
আসুন। ভেতর থেকে আহ্বান আসে।
দরজা ঠেলে কিরীটী ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল।
খোলা দরজার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে ছিলেন অবিনাশ চৌধুরী।
হাত দুটি তাঁর পশ্চাতের দিকে নিবদ্ধ। পরিধানে দামী শান্তিপুরী মিহি ধুতি। গিলে করা কোঁচাটা মেঝেতে লুটোচ্ছে। গায়ে একটা সবুজ রঙের কাশ্মীরী কলকাতোলা দামী শাল।
মেঝেতে পুরু দামী গালিচা বিছানো। একপাশে কয়েকটি বাদ্যযন্ত্র এলোমেলো পড়ে আছে। দেয়ালের দিকে ঘেঁষে একটি কাঁচের আলমারি। ভেতরে সুন্দরভাবে সাজানো নানা বই।
অবিনাশ চৌধুরী একবার ফিরেও তাকালেন না। যেমন পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তেমনই নিঃশব্দে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন।
কিরীটীও নিঃশব্দে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল।
তারপর রায় মশাই, কি মনে করে আমার ঘরে? মৃদু শান্ত কণ্ঠে এক সময় অবিনাশ চৌধুরী আগের মত দাঁড়ানো অবস্থাতেই প্রশ্ন করলেন।
আপনার সঙ্গে কয়েকটা কথা ছিল কাকা সাহেব।
কথা?
আজ্ঞে।
আবার কিছুক্ষণ পীড়াদায়ক স্তব্ধতা।
কেবল ঘরের দেয়ালে বসানো একটি সুদৃশ্য দামী জামান ক্লক সময়-সমুদ্রের বুকে একটানা শব্দ জাগিয়ে চলেছে টক টক টক্ টক্ টক।