কিরীটী দুঃশাসন চৌধুরীর জবাবে কিছুক্ষণ চুপ করে কি যেন ভাবে, তারপর আবার তাঁর মুখের দিকে চেয়ে প্রশ্ন শুরু করে, দালাল সাহেবের কাছে জবানবন্দিতে আপনি রুচিরা দেবীর কথায় অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেছেন, আপনি রায়বাহাদুরের নিহত হওয়ার সংবাদটা নাকি তাঁকে আদৌ দেননি। অথচ রুচিরা দেবী জোর দিয়ে বলছেন—
সে মিথ্যে কথা বলছে। আমি কেবল বৃহন্নলাকে সংবাদটা দিয়েছিলাম।
হুঁ। আচ্ছা রায়বাহাদুরের ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে যে ভৃত্যটিকে আপনি দেখেছিলেন তার নাম কি?
কৈরালাপ্রসাদ।
কতদিন সে এখানে আছে?
দাদার খাসভৃত্য, শুনেছি বছর পাঁচেক সে এ বাড়িতে কাজ করছে, ইদানীং রোগীর ঘরের যাবতীয় ফাইফরমাশই সে খাটত।
লোকটা বিশ্বাসযোগ্য নিশ্চয়ই?
হ্যাঁ, সেই রকমই তো মনে হয়।
আচ্ছা আপনি যদি রুচিরা দেবীকে সংবাদটা না দিয়ে থাকেন, তাঁকে কে ঐ সংবাদটা দিতে পারে বলে আপনার মনে হয়?
বলতে পারি না।
আপনি কি বিয়ে করেছেন?
কিরীটীর প্রশ্নটা যেন অত্যন্ত অতর্কিত ভাবেই আসে। এবং প্রশ্নের জবাবটা সঙ্গে সঙ্গে না দিয়ে একটু যেন ইতস্ততঃ করেই দুঃশাসন চৌধুরী বললেন, না।
আর একটি কথা মিঃ চৌধুরী, রায়বাহাদুরের যে বদ্ধমূল ধারণা হয়েছিল গতকাল রাত ঠিক চারটের সময়ই তাঁর মৃত্যু হবে বা কেউ তাঁকে হত্যা করবে—এ ধরণের বদ্ধমূল ধারণা হবার কোন কারণ ছিল বলে আপনি জানেন কিছু?
না। সত্যি কথা বলতে কি মিঃ রায়, ব্যাপারটাকে তো আমি শোনা অবধি হাস্যকর বলেই কোন গুরুত্ব দিইনি গোড়া থেকেই।
আচ্ছা আপনি এবার যেতে পারেন। বৃহন্নলা চৌধুরীকে একটিবার পাঠিয়ে দিন এ ঘরে।
১৪. বৃহন্নলা চৌধুরী ও কিরীটীর মধ্যে কথাবার্তা
বৃহন্নলা চৌধুরী ও কিরীটীর মধ্যে কথাবার্তা হচ্ছিল।
গতরাত্রে রায়বাহাদুরের নিহত হবার সংবাদ পেয়েই আমি যখন রায়বাহাদুরের ঘরের মধ্যে প্রবেশ করি, সেখানে আপনার কাকা ও আপনাকে আমি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম। কিন্তু একটু পরে লক্ষ্য করে দেখি আপনি ঘরে নেই। হঠাৎ ঘর থেকে চলে গিয়েছিলেন কোথায় আর কেনই বা গিয়েছিলেন!
আমার ঘরে কাকা যখন আমার শোবার ঘরে গিয়ে বাবার নিহত হবার সংবাদটা দেন আমি একেবারে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। তারপর কাকার সঙ্গে সঙ্গেই বাবার ঘরে গিয়ে ঢুকি কিন্তু পরে ঐ ভীষণ দৃশ্য দেখেই সমস্ত মাথাটা যেন কেমন আমার বোঁ বোঁ করে হঠাৎ ঘুরে উঠল। আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। তাড়াতাড়ি আবার ঘর থেকে বের হয়ে যাই, তারপর আবার দালাল সাহেব ডেকে পাঠাতে ফিরে আসি।
রাত্রি সাড়ে তিনটে থেকে আপনার কাকা আপনাকে ডাকতে যাওয়া পর্যন্ত আপনি কি করছিলেন?
গতকালই তো আমি বলেছি, শরীরটা আমার বিশেষ ভাল না থাকায় সন্ধ্যে থেকেই প্রায় আমি আমার ঘরেই ছিলাম। বিছানাতেই শুয়ে ছিলাম, তবে ঠিক ভাল ভাবে ঘুমোইনি। একটা আধো ঘুম আধো জাগা অবস্থা।
একটা কথা বৃহন্নলাবাবু, আপনি কি সত্যিই আপনার বাবার কোন উইল আছে বলে জানেন?
যতদূর জানি বাবার কোন উইল নেই। আর থাকলেও আমার সেটা জানা নেই মিঃ রায়।
আপনি বলতে পারেন, আপনার কাকা দুঃশাসন চৌধুরীর প্রতি আপনার বাবার ঠিক মনোগত ভাবটা কেমন ছিল?
কিরীটীর প্রশ্নে স্পষ্টই বোঝা গেল বৃহন্নলা চৌধুরী যেন একটু ইতস্ততই করছেন। জবাবটা দিতে কেমন যেন একটু সংকোচ ও দ্বিধা বোধ করছেন।
অবশ্য আপনি যতটুকু জানেন, ততটুকুই আমি জানতে চাই আপনার কাছ থেকে বৃহন্নলাবাবু!
কাকা তো মাত্র মাসখানেক হল ফিরে এসেছেন। এই সময়ের মধ্যে তেমন বিশেষ কিছু আমার চোখে পড়েছে বলে তো কই আমার মনে পড়ছে না। তবে ইতিমধ্যে কাকা এখানে আসবার পরই একদিন রাত্রে, জানি না কি কারণে বাবা ও কাকা দুজনের মধ্যে একটা বচসা ও কথা-কাটাকাটি হয়েছিল এবং পরদিন সকালেই এখান থেকে মাইল পনের দূরে একটা কোলিয়ারীতে কাকা চলে যান।
সে বচসার বিষয়বস্তুটা কি ছিল কিছুই জানেন না?
না।
সে ঘরে আর কেউ ছিল?
না।
আপনি সে কথা জানলেন কি করে?
কি একটা স্টেটের কাজেই এ সময় বাবার ঘরের দিকে যাচ্ছিলাম। দরজার কাছাকাছি যেতেই শুনলাম কাকা খুব যেন রাগত ভাবেই চেঁচিয়ে কথা বলছেন।
শুনতে পেয়েছিলেন তাঁর কোন কথা? মনে করে বলতে পারেন কিছু?
হ্যাঁ, একটা কথা কেবল শুনতে পেয়েছিলাম, কাকা বলছিলেন, এ তোমার অত্যন্ত অন্যায়। এভাবে বঞ্চিত করবার তোমার কোন আইনগত অধিকার নেই জানবে। তার পরই কাকা দেখলাম ঘর থেকে দ্রুত চঞ্চল পদেই যেন বের হয়ে গেলেন। বাবার ঘরে ঢুকে দেখি বাবাও যেন তখন বেশ উত্তেজিত, কিন্তু তাঁর সঙ্গে ঐ সম্পর্কে আমার কোন কথাই হয়নি সে-সময়ে।
হুঁ। আপনার প্রতি আপনার কাকার মনোগত ভাবটা তত ভাল বলেই মনে হল, তাই না?
হ্যাঁ, কাকা আমাকে চিরদিনই একটু বেশী স্নেহ করেন। বিদেশে থাকাকালীন একমাত্র আমার কাছেই তিনি যা চিঠিপত্র মধ্যে মধ্যে দিতেন।
মৌচীর মাইকার বিজনেস তুলে দিয়ে বাঙলাদেশে ফিরে আসবার জন্য আপনার কাকাকে শুনলাম আপনার বাবাই নাকি পীড়াপীড়ি করেছিলেন, কথাটা সত্যি।
হ্যাঁ। বাবা কাকাকে একমাত্র ভাই বলে চিরদিনই বিশেষ একটু স্নেহ করতেন। কাকার বিদেশ যাওয়াটা শুনেছিলাম বাবার অমতেই হয়েছিল।
বিদেশ যাওয়ার আপনার কাকার কোন কারণ ছিল বলে জানেন?
বিদেশ যাওয়ার আগে কাকা বাবার ব্যবসাতেই কাজ করতেন। তারপর সঠিক আমি জানি না আসল ব্যাপারটা কি, তবে মনে হয় ব্যবসা-সংক্রান্ত ব্যাপারেই বোধহয় কি একটা গোলমাল হয়। তারপরই কাকা বাবার কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে মৌচীতে তাঁর এক বন্ধু মাইকার বিজনেস করছিলেন সেই বিজনেসে গিয়ে যোগ দেন। এবং শুনেছি ব্যবসাতে নাকি তাঁর খুব উন্নতি হয় এবং যথেষ্ট অথগমও হতে থাকে।