দরজার গায়ে কলিং বেল টিপতেই অল্পক্ষণ পরে নিঃশব্দে বৃহৎ দ্বার উন্মুক্ত হল।
চলুন—
প্রকাণ্ড একটা হলঘর। একটি মাত্র স্বল্প-শক্তির নীলাভ বৈদ্যুতিক বাতির আলোয় ঘরটা স্বল্পালোকিত। বারেকের জন্য চোখ তুলে সমর ঘরের চতুর্দিকে একবার দৃষ্টিপাত করল।
ঐশ্বর্যের প্রাচুর্যে সমগ্র ঘরখানি যেন একেবারে ঠাসা, তবে রুচি বা শৃঙ্খলার কোন চিহ্নই পরিলক্ষিত হয় না। মেঝেতে পুরু গালিচা বিস্তৃত: বড় বড় কারুকার্যমণ্ডিত মেহগনি কাঠের আলমারি গোটাচারেক। একপাশে খানপাঁচেক সোফা। একপাশে প্রকাণ্ড একটি শ্বেতপাথরের টেবিল টেবিলের দুদিকে খান আষ্টেক চেয়ার।
এক কোণে একটি ট্যান করা বৃহৎ ব্যাঘ্রমূর্তি জিঘাংসায় ধারাল দন্ত বিকশিত করে আছে। কাঁচের চোখ দুটো ধকধক করে জ্বলছে নীলাভ দ্যুতিতে।
দেওয়ালের সর্বত্র বড় বড় সব বিদেশী নরনারীর তৈলচিত্র।
বেশীর ভাগই ইংরাজ অধীশ্বর ও অধীশ্বরীদের। এক কোণে সুবৃহৎ পাথরের স্ট্যাণ্ডে একটি সুদৃশ্য দামী জামান ক্লক দণ্ডায়মান। ঐ সময় হঠাৎ ঢং ঢং করে রাত দুটো ঘোষণা করল ক্লকটা। ক্লকের সঙ্কেতধ্বনি যেমন গম্ভীর তেমনি মিষ্টি।
ঘড়ির ঘণ্টাধ্বনিটা প্রায় মিলিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই অদ্ভুত বামন আকৃতির এক নেপালী ভৃত্য ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করতেই কুণ্ডলেশ্বর তাকে সম্বোধন করে বলে, সিক্রিটারীবাবুকে সংবাদ দে কৈরালা, ডাক্তারবাবু এসেছেন।
ডাক্তার সাকা উপরমে লে যানে কো হুকুম হায়, কৈরালা বলে।
ও, বলছিলাম কি, তাহলে আজ্ঞে যান ওর সঙ্গেই। আমি আপনার ব্যাগটি পাঠিয়ে দিচ্ছি।
সহসা এমন সময় আবার সেই পূর্বের বিশ্রী চিৎকারটা রাত্রির অন্ধকারে শোনা গেল।
ও কিসের চিৎকার কুণ্ডলেশ্বরবাবু? সমর প্রশ্ন না করে আর পারে না।
আজ্ঞে, নাইটকীপার হুম্ সিং পাহারা দিচ্ছে। আজ্ঞে তাহলে বলছিলাম কি আপনি যান—
নাইটকীপার?
হ্যাঁ, নাইটকীপার হুম্ সিং সারারাত জেগে অমনি করে শ্রীনিলয় পাহারা দেয়।
চলিয়ে ডাক্তার সাব—
কৈরালাপ্রসাদের ডাকে সমরের সম্বিৎ যেন আবার ফিরে আসে। আত্মগত চিন্তায় সে কেমন যেন একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল।
চল—
কৈরালাপ্রসাদকে অনুসরণ করে সমর।
হলঘরটি অতিক্রম করে উভয়ে আর একটি স্বল্পালোকিত দীর্ঘ লম্বা বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। এত বড় বারান্দায় কেবলমাত্র একটি সিলিং থেকে ঝুলন্ত স্বল্প-শক্তির বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলছে, সে আলোয় অন্ধকার তো দূরীভূত হয়ইনি বরং অন্ধকার আরও যেন ঘন ও রহস্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
সমরের কেমন বিস্ময় বোধ হচ্ছিল। এত বড় জাঁকজমকপূর্ণ ধনীর প্রাসাদতুল্য বাড়ি অথচ আলোর ব্যবস্থা এত কম কেন!
আর আলোর ব্যবস্থায় অহেতুক এই কার্পণ্যই বা কেন! এর কারণই বা কি?
শুধু আলোর ব্যবস্থাই যে কম তাই নয়, সমস্ত বাড়িটা জুড়ে অদ্ভুত একটা স্তব্ধতাও যেন থম থম করছে।
মনে হয় যেন এ কারও কোন বাড়ি বা বাসস্থান নয়, কোলাহলমুখরিত নগরীর দূরপ্রান্তে পরিত্যক্ত ভয়াবহ এক নিঃশব্দ বিরাট কোন এক কবরখানা।
রাত্রির অন্ধকারে সেখানে কালো বাদুড়ের ডানার মত ছড়িয়ে পড়ে নিঃসীম কালো শুন্যতা। অশরীরী প্রেতের নিঃশব্দ পদবিক্ষেপে ও দীর্ঘশ্বাসে সেখানকার বায়ুতরঙ্গ হিমানীর মত ঠাণ্ডা, সবাঙ্গে শিহরণ জাগায়, প্রতি রোমকূপে রোমকূপে ভীতির অনুভূতি তোলে।
বলাই বাহুল্য সিঁড়িপথেও তেমন আলোর ব্যবস্থা নেই। মৃদু আলোছায়াচ্ছন্ন প্রশস্ত সিঁড়িপথ অতিক্রম করে বামন আকৃতির কৈরালাপ্রসাদকে অনুসরণ করে দ্বিতলে অনুরূপ একটি দীর্ঘ বারান্দার প্রান্তে এসে সমর দাঁড়ায় এবং সেখানে পৌঁছেই বামন কৈরালাপ্রসাদ ঘুরে দাঁড়ায় এবং চাপা কণ্ঠে বলে, চলে যান, সামনেই ঘর।
কথা কটি বলে এবং দ্বিতীয় কোন বাক্যোচ্চারণে সমরকে অবকাশ মাত্রও না দিয়ে নিমেষে অত্যন্ত দ্রুতপদে কৈরালাপ্রসাদ সিঁড়িপথ দিয়ে নেমে অদৃশ্য হয়ে গেল।
ঘটনার অত্যন্ত দ্রুত আকস্মিকতায় সমর যেন কতকটা হতবুদ্ধি ও বিহ্বল হয়ে আলোছায়াচ্ছন্ন বারান্দার প্রান্তে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে।
সম্মুখে পর পর অনেকগুলি ঘরের দরজা। কৈরালাপ্রসাদ বলে গেল সামনের ঘরে যেতে কিন্তু কোন্ ঘরে সে যাবে!
হতবুদ্ধি সমর যন্ত্রচালিতের মতই কতকটা অগ্রসর হয়ে প্রথম বন্ধ দরজাটার গায়ে হাত দিয়ে ঈষৎ ঠেলা দিতেই দরজা খুলে গেল এবং সঙ্গে সঙ্গে মধুর বীণাযন্ত্রসহযোগে অপূর্ব সুমিষ্ট নারীকণ্ঠসঙ্গীতের একটা ঝাপটা কানে এসে প্রবেশ করে : খুল খুল যায় বাজুবন্দ।
সঙ্গীত ও সেই সুরের আকর্ষণে বোধ হয় মন্ত্রমুগ্ধের মত অত্যুজ্জ্বল আলোকোদ্ভাসিত সেই কক্ষের উন্মুক্ত দ্বারপথেই ভিতরে গিয়ে দাঁড়ায় সমর।
উজ্জ্বল বৈদ্যুতিক আলোর প্রভায় সমগ্র কক্ষখানি যেন ঝলমল করছিল।
বাড়ির সর্বত্র অন্ধকার অথচ ঐ কক্ষটি যেন আলোয় ঝলমল। তাছাড়া রোগী দেখতে এই মধ্যরাত্রে যে বাড়িতে সে এসেছে সেই বাড়িরই কোন ঘরে ঐ রকম সঙ্গীতের আনন্দ বসবে ব্যাপারটা সহসা যেন কেমন সমর সেনের বোধগম্য হয় না। তাই কতকটা বিস্ময় বিমূঢ় হয়ে সে দাঁড়িয়ে যায়।
সমস্ত মেঝে জুড়ে দামী গালিচা বিস্তৃত এবং মাঝখানে ফরাস বিছানো। সেই ফরাসের উপর অপূর্ব সুন্দরী এক যুবতী কোলের কাছে বীণা নিয়ে বীণে সুরঝঙ্কারের সঙ্গে নিজের মধুস্রাবী কণ্ঠস্বরকে গঙ্গা-যমুনার ধারার মতই মিলিয়ে দিয়েছে।