ঘরের মধ্যে হঠাৎ যেন বজ্রপাত হল।
কি বলছেন আপনি মি রায়, আমি তখন জেগে একটা বই পড়ছিলাম—ডাঃ সানিয়ালই কাল রাত্রেও আমাকে নিজে এসে কফি দিয়ে গেলেন!
না, বললাম তো, কাল রাত্রে তিনি যে অন্ততঃ আপনাকে কফি দিতে আসেননি সে বিষয়ে আমি স্থিরনিশ্চিত। কারণ সে সময়ে তাঁর ঘরেই তিনি উপস্থিত ছিলেন।
না, তা হতে পারে না।
হওয়া-হওয়ির কথা এ নয় মিস কর, কারণ it is a fact। তাছাড়া আমি নিজে ও ডাঃ সেন ঐ সময় ডাক্তারের ঘরে বসে সকলে মিলে তাঁরই হাতে তৈরী কফি পান করছিলাম। কাজেই বুঝতে পারছেন, তিনি কিছু আর ম্যাজিকের দ্বারা নিজেকে অদৃশ্য করে কিংবা আমাদের hypnotise করে আমাদের চোখের সামনেই সে ঘর থেকে বের হয়ে এসে আপনাকে কফি দিয়ে যেতে পারেন না!
সুলতারও বিস্ময়ের যেন অবধি থাকে না। বিস্মিত ব্যাকুল কণ্ঠে সে বলে ওঠে, কিন্তু বিশ্বাস করুন মিঃ রায়, আমি বলছি সত্যিই তিনি গত রাত্রে কফি দিয়ে গিয়েছিলেন আমাকে নিজে এসে অন্যান্য দিনের মত।
বা দেননি, তবু আপনি যখন বলছেন—আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, সেটা আপনার দেখবার ভুল সুলতা দেবী।
দেখবার ভুল!
হ্যাঁ। বা এমনও হতে পারে, আপনি আদৌ ভাল করে দেখেননি চেয়ে কে গত রাত্রে আপনাকে কফি দিয়ে গেল—মানে হয়ত অন্যমনস্ক ছিলেন কোন রকম!
তবে—একটা ভয়ার্ত শঙ্কিত দৃষ্টি সুলতার দু চোখের তারায় ফুটে উঠল।
হ্যাঁ, এ-কথা অবিশ্যি সত্যি একজন কেউ এসে গত রাত্রে কফি দিয়ে গিয়েছেন, তিনি অবিকল ডাঃ সানিয়ালের মত দেখতে হলেও আসল ডাঃ সানিয়াল নন। অন্য কেউ। কিন্তু কে সে? সেই-ই হচ্ছে প্রশ্ন—শেষের কথাটা কিরীটী যেন আত্মগত ভাবেই উচ্চারণ করে কতকটা।
আপনার কথা যে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না মিঃ রায়। তিনি ডাক্তারের মত দেখতে, অথচ তিনি নন!
বললাম তো একটু আগে আপনাকে, এ বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কথা নয়, নিষ্ঠুর সত্য যা ঘটেছিল কাল রাত্রে তাই বলেছি আপনাকে আমি। আচ্ছা এবারে আপনি বাড়ি যেতে পারেন মিস কর।
বাড়ি যাব?
হ্যাঁ। প্রয়োজন হলে আমরাই দেখা করব। কেবল এই জায়গা ছেড়ে পুলিসের বিনা অনুমতিতে কোথাও আপাততঃ যাবেন না।
সুলতা নিঃশব্দে শ্লথ গতিতে কক্ষ থেকে বের হয়ে গেল।
.
ধীরে ধীরে সুলতা করের পায়ের শব্দটা বারান্দায় একসময় মিলিয়েও গেল।
সুলতার সঙ্গে কথা বলতে বলতে কখন যে এক সময় হাতের সিগারটা নিভে গিয়েছে কিরীটীর খেয়ালও হয়নি। আবার নিবাপিত সিগারটায় অগ্নিসংযোগ করে হাতের দেশলাইয়ের কাঠিটা ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে ঘরের কোণে ছুঁড়ে ফেলে দিল।
নেহাৎ একটা অনুমানের ওপর একান্তভাবে নির্ভর করে কিরীটী সুলতাকে প্রশ্ন করেছিল ঐভাবে এবং অকস্মাৎ তার হাতের মধ্যে একটি মূল্যবান সূত্র (clue) এসে গেল।
সুলতাকে প্রশ্ন করতে করতে এবং তার জবাবের পর কিরীটীর এখন আর বুঝতে আদৌ কষ্ট হয় না যে গত দশদিন ধরে ডাঃ সানিয়লের পরামর্শ ও উপদেশ মতই সুলতা রাত্রে নিদ্রাকে এড়াবার জন্য কফি পান করছিল এবং হত্যাকারী যে উপায়েই হোক সেই কথাটি জানতে পেরে পূর্বাহ্নে সেই সুযোগটি চমৎকার কৌশলের সঙ্গে কাজে লাগিয়েছে। অপূর্ব চাতুর্যের সঙ্গেই সে নির্দিষ্ট একটি সময়ের পরিপূর্ণ ভাবেই সুযোগ নিয়েছে। ভাবতেও বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে যেতে হয় কি অসাধারণ বুদ্ধিচাতুর্য দুঃসাহস ও ক্ষিপ্রতার পরিচয় সে দিয়েছে এক্ষেত্রে।
আর রায়বাহাদুর যদি সত্যিই তা সে যে ভাবেই হোক, জেনে থাকেন তাঁর এই মৃত্যুর ব্যাপারটা, তারপর তাঁকে ঠিক পূর্বাহ্নে এভাবে জ্ঞাত করে কেউ যে এমনভাবে পরিকল্পনানুযায়ী হত্যা করতে পারে এ যেন কিরীটীর স্বপ্নেরও অতীত।
কিন্তু সুলতা কর, তার কথাগুলো কি সত্যিই বিশ্বাসযোগ্য?
সত্যি কি সুলতা কর গত রাত্রের কফি পরিবেশনকারীকে চিনতে পারেনি, না ইচ্ছে করেই অর্থাৎ কথাটা জেনেও গোপন করে গেল?
.
মনে মনে কিরীটী গত রাত্রের ব্যাপারটা আর একবার পর্যালোচনা করে। রায়বাহাদুর ঘরের যে অংশে রোগশয্যায় শায়িত ছিলেন সেখানে নীল বাতিটা ডোমে ঢাকা থাকার দরুণ স্থানটি তেমনি সুস্পষ্ট ভাবে আলোকিত ছিল না। ঘরের অন্য অংশ হতে সেই স্থানটি একটা ভারি কালো পর্দা টাঙিয়ে ব্যবধানের সৃষ্টি করা হয়েছিল এবং যে সময় হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়—ঘরের মধ্যে অসুস্থ, ওষুধের প্রভাবে নিদ্রিত, রায়বাহাদুর ও পার্শ্বে একটি চেয়ারে ঐ একই ভাবে ওষুধের প্রভাবে নিদ্রিত নার্স সুলতা কর ব্যতীত আর কোন তৃতীয় প্রাণীই অকুস্থানে ছিল না। এবং রাত্রি সাড়ে তিনটে হতে চারটে বাজবার মধ্যে যে আধ ঘণ্টা সময়, ঐ সময়ের মধ্যেই কোন এক মুহূর্তে কৌশলে সুলতা করকে ঘুম পাড়াবার জন্য ঘুমের কোনো তীব্র ওষুধ-মিশ্রিত কফি পান করানো হয়েছিল তার অজ্ঞাতেই। তারপর নিশ্চয়ই সুলতার কফি পানের পর নিদ্রাভিভূত হতে অন্ততঃ মিনিট দশ-বারো সময় তো লেগেছে। তাহলে বাকি থাকে কেবল হিসেবমত ঐ আধ ঘণ্টার মধ্যে মিনিট পনের, যে সময়ের মধ্যে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে।
মাত্র পনের মিনিট সময়। এবং গতরাত্রের ঐ পনের মিনিট সময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময় তদন্তের ব্যাপারে। কাজেই এখন খোঁজখবর নিয়ে দেখতে হবে ঐ পনের মিনিট সময়ে অর্থাৎ রাত্রি পৌনে চারটে থেকে রাত্রি চারটে পর্যন্ত এই বাড়ির সকলে কে কোথায় কোন অবস্থায় ছিল। ঐ পনের মিনিট সময়ের মধ্যেকার প্রত্যেকের গতিবিধি চেক করা একান্ত প্রয়োজন। কারণ স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে যে, ঐ পনের মিনিট সময়ের মধ্যেকার প্রত্যেকের গতিবিধি বা অবস্থানই বর্তমানে এই হত্যা-ব্যাপারের রহস্যোদঘাটনে সর্বাপেক্ষা মূল্যবান সূত্র।
১২. কিরীটী পকেট থেকে তার নোট বুকটা
কিরীটী পকেট থেকে তার নোট বুকটা বের করল এবংনিম্নলিখিত কথাগুলো মনে মনে পর্যালোচনা করে এক, দুই, তিন ক্রমিক নম্বর দিয়ে পর পর লিখে যেতে লাগল।