রুচিরা এ বাড়িতে বেশী একটা থাকে না।
সে কলকাতায় কলেজে পড়ে। মধ্যে মধ্যে ছুটিছাটায় কেবল কখনও বেড়াতে আসে, আবার ছুটি ফুরোলেই কলকাতায় ফিরে যায়।
এ বাড়ি সম্পর্কে তার এই কারণেই বোধ হয় এতটুকুও কৌতূহল কোনদিন ছিল না।
এ বাড়ির আবহাওয়া হতে শুরু করে এই বাড়ির লোকগুলিও যেন কেমন তার নিকট অদ্ভুত বিচিত্র বলে মনে হয়।
কেমন যেন একটা চাপা গুমোট ভাব, একটা বিকৃত শাসনের নাগপাশ যেন এই বাড়ির প্রাণকে চেপে রেখেছে অষ্টপ্রহর।
এখানে প্রত্যেকেই প্রত্যেক হতে স্বতন্ত্র, কেউই যেন কারও আপনার নয়।
কারও সঙ্গে কারও যেন বিন্দুমাত্রও মনের যোগাযোগ নেই। কারও জন্য কারও যেন এতটুকু সমবেদনা স্নেহ বা ভালবাসা নেই।
মনে হয় কেমন প্রত্যেকেই যেন একটা কুৎসিত স্বার্থের ঘূণাবর্তের মধ্যে পাক খেয়ে খেয়ে এ বাড়ির আবহাওয়াকে বিষাক্ত ও ঘোলাটে করে রেখেছে।
কেউ কাউকে বিশ্বাস পর্যন্ত যেন করে না।
এবং যতবারই সেই কারণে রুচিরা এখানে এসেছে এবং যে কদিন থেকেছে, নিজেকে যেন এ বাড়ির সকল কিছু থেকে কতকটা ইচ্ছে করেই পৃথক করে রেখেছে, নিজের স্বাতন্ত্র নিয়ে দিনগুলো কাটিয়েছে।
আর একটা কথা। এ বাড়িতে এসে থাকাকালীন সময়ে তবুও কদাচিৎ কখনও অন্য সকলের ঘরে গেলেও এবং একটা-আধটা কথা কারও সঙ্গে বললেও, কেন যেন আজ পর্যন্ত ছুটিছাটা উপলক্ষে ইতিপূর্বে সে এ বাড়িতে যতবার এসেছে কোনবারই দাদু অবিনাশ চৌধুরীর মহলে সে প্রবেশ করেনি এবং সেই কারণেই বোধ হয় বাঈজীকে দেখেনি বা দেখতে পায়নি। অবিশ্যি বাঈজীর এ বাড়িতে এই প্রথম পদার্পণ নয়।
গতকাল প্রত্যুষে তাই সে যখন অন্দরের বাগানে বেড়াচ্ছিল, এক মুহূর্তের জন্য দূর থেকে ভ্রমণরতা বাঈজীকে দেখেই সে যেন চমকে উঠেছিল।
চমকাবার অবিশ্যি কারণও ছিল। মুখটা যেন কেমন দূর থেকেই চেনা-চেনা লেগেছিল। কোথায় কবে যেন সে এ মুখটির সঙ্গে বিশেষ ভাবেই পরিচিত ছিলও। কিন্তু ভেবে কিছুই ঠিক করতে পারছিল না।
অবশেষে আর কৌতূহলকে দমন করতে না পেরে আজ খোঁজ করতে করতে বাঈজীর ঘরে এসে নিজেই প্রবেশ করেছে।
বাঈজী তানপুরায় ভৈরো রাগ আলাপ করছিল। আপন মনেই বাঈজী আলাপ করছিল, রুচিরা যে তার ঘরে এসে ঢুকেছে সে টেরও পায়নি। চেয়েছিল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রুচিরা বাঈজীর দিকে। কণ্ঠস্বর ও বসবার ভঙ্গীটি পর্যন্ত তার যেন কতই না পরিচিত।
কে—কে ঐ বাঈজী?
দাদুর গান-বাজনার প্রচণ্ড নেশা আছে ও জানত এবং মধ্যে মধ্যে নাকি বাঈজীরা দাদুর কাছে গানের মুজরা নিয়ে আসে এ গৃহে দু-চার-দশ দিনের জন্য।
সে কারণে বাঈজীর প্রতি আকৃষ্ট হয়নি সে, হয়েছিল গতকাল সন্ধ্যায় দূর থেকে উদ্যানে ভ্রমণরতা বাঈজীকে দেখে।
আলাপ শেষ হতেই তানপুরাটা কোলের কাছে নামিয়ে রেখে গুনগুন করে তখনও সুর ভাঁজতে ভাঁজতে সামনের দিকে তাকাতেই বাঈজীর সামনে দর্পণে প্রতিফলিত ঠিক পিছনেই নিঃশব্দে দণ্ডায়মানা রুচিরার প্রতিকৃতির প্রতি দৃষ্টি পড়তেই চমকে বাঈজী ফিরে তাকায়।
পরস্পরের সঙ্গে চোখাচোখি হল। কিছুক্ষণ পরস্পর পরস্পরের দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। কথা বলে প্রথমে এবারে রুচিরাই, সাবিত্রী না? এতক্ষণে রুচিরা চিনতে পেরেছে বাঈজীকে।
বাঈজী আর কেউ নয়, সাবিত্রী। বেথুনে ম্যাট্রিক পড়বার সময় তার সহপাঠিনী তো ছিলই, রুচিরার সঙ্গে হোস্টেলের একই ঘরে বাসও করেছিল সে কয়েক মাস।
অত্যন্ত অন্তরঙ্গতা একদিন ছিল ওদের পরস্পরের মধ্যে।
রুচি!
এতক্ষণে বাঈজীরও কণ্ঠস্বর শোনা গেল।
হ্যাঁ। আশ্চর্য! কিন্তু তুই এখানে? রুচিরা প্রশ্ন করে।
মৃদু হাসির একটা আভাস যেন খেলে যায় বাঈজীর ওষ্ঠের ওপরে, হ্যাঁ। আজ আমার পরিচয় আর সাবিত্রী নয়, আজ আমি মুন্না বাঈজী।
মুন্না বাঈজী!
হ্যাঁ। কিন্তু তুই এখানে? কিছুই তো বুঝতে পারছি না রুচি! সাবিত্রী দ্বিতীয়বার আবার প্রশ্ন করে।
এটা তো আমার মামার বাড়ি। তুই তো জানিস মামাদের পয়সা ও দয়াতেই আমি মানুষ।
হ্যাঁ হ্যাঁ, ভুলে গিয়েছিলাম—কত দিনকার কথা। প্রায় তিন-চার বছর হবে, তাই না?
তা হবে বৈকি।
রায়বাহাদুর—যিনি গতকাল—
হ্যাঁ, তিনিই আমার মামা। আর অবিনাশ চৌধুরী—ওঁর কাকা হলেন আমার দাদু।
ও।
সাবিত্রী যেন হঠাৎ চুপ করে গেল।
খোলা বাতায়ন-পথে দৃষ্টি প্রসারিত করে অতঃপর নিঃশব্দে বসে রইল কিছুক্ষণ সাবিত্রী।
রুচিরা একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে তখন সাবিত্রী— মুন্না বাঈজীর দিকে।
সাবিত্রী!
তার সহপাঠিনী সাবিত্রী—যার রূপের ও কণ্ঠের খ্যাতি একদিন সমস্ত কলেজ ছাত্রীদের মধ্যে হিংসার বস্তু ছিল!
লেখাপড়ায় সাবিত্রী কোন দিনই ভাল ছিল না তেমন, অত্যন্ত সাধারণ শ্রেণীর ছাত্রী ছিল।
কিন্তু তবু সারা কলেজে তাকে চিনত না এমন কেউ ছিল না, তার মধুক্ষরা কণ্ঠের জন্য।
নিঃশব্দে সাবিত্রী বসে আছে।
খুব প্রত্যুষেই বোধহয় স্নান করেছে। পরিধানে সাদা মিলের নরুণপাড় একটা ধুতি। দু কাঁধের ওপর দিয়ে সিক্ত চুলের গোছা বুকের দুপাশে বিলম্বিত।
কপালে দুই জ্বর মধ্যস্থলে একটি বোধ হয় শ্বেতচন্দনের টিপ।
সিঁথিতে বা কপালে এয়োতির চিহ্নমাত্রও নেই। অথচ সাবিত্রী তো বিবাহিতাই ছিল যতদূর ওর মনে পড়ে। ওর সমগ্র চোখেমুখে যেন একটা বিষণ্ণ করুণ দুঃখের ও ক্লিষ্ট যাতনার ছায়া।