গান্ধারী দেবী কিরীটীর কথায় যেন সত্যিই একেবারে বোবা হয়ে যান।
তাহলেই এখন বুঝতে পারছেন তো কেন আমি আপনার নিদ্রা সম্পর্কে সন্দিহান?
এবারেও গান্ধারী দেবী কিরীটীর কথার কোন প্রত্যুত্তর দিলেন না।
গান্ধারী দেবী, মিথ্যে আপনি সব কথা আমার কাছে গোপন করবার চেষ্টা করছেন এখনও!
সহসা এবারে গান্ধারী দেবী একটু যেন রূঢ় কণ্ঠেই জবাব দিলেন, আমি কিছুই জানি না কিরীটীবাবু। কেবল এইটুকু বলতে পারি, সম্পূর্ণ একটা ভুল ধারণার বশবর্তী হয়েই মিথ্যে আপনি আমাকে জেরা করছেন।
যদি তাই হয়, তবে একটু আগে এই ঘরে ঢোকবার মুহূর্তে শকুনিবাবুকে যে কথাটা বলতে গিয়ে তৃতীয় ব্যক্তি আমাকে এখানে দেখেই হঠাৎ চুপ করে গেলেন—সে কথাটা কি? কি কথা ওঁকে বলতে যাচ্ছিলেন—সেটা অন্ততঃ জানতে পারি কি?
না।
যেন একটা রূঢ় কঠিন আঘাতের মতই না শব্দটি কিরীটীর মুখের ওপর এসে পড়ে তাকেও নিশ্চুপ করে দিল।
ক্ষণকাল গভীর অনুসন্ধানী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিরীটী গান্ধারী দেবীর মুখের দিকে চেয়ে থেকে হঠাৎ বলে ওঠে, গান্ধারী দেবী, একটা কথা—সমীরবাবুর সঙ্গে সত্যিসত্যিই কি আপনার মেয়ে রুচিরা দেবীর বিবাহ-ব্যাপারটা স্থির হয়ে গিয়েছে?
হ্যাঁ। ধীর কণ্ঠে গান্ধারী দেবী এবারে জবাব দিলেন।
আপনার নিশ্চয়ই এ বিবাহে খুব মত আছে?
আছে।
আপনার মেয়ে রুচিরা দেবীর?
কিরীটীবাবু, এটা সম্পূর্ণ আমাদের পারিবারিক ও ব্যক্তিগত ব্যাপার। এর সঙ্গে দাদার মৃত্যুর কোন সংস্পর্শ আছে বলেই আমি মনে করি না। অতএব একান্তই অবান্তর নয় কি প্রশ্নটা আপনার?
ব্যক্তিগত ও পারিবারিক হলেও আমি এ প্রশ্নটার জবাব চাই গান্ধারী দেবী!
আর যদি না দিই?
তাহলে বলব মিথ্যেই আপনি সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে জেদাজেদি করছেন, কারণ আপনি ঢাকবার বা গোপন করবার চেষ্টা করলে কি হবে আমি আগেই জেরা করে রুচিরা দেবীর কাছ থেকে তাঁর কথাতেই জেনেছি।
কি–কি জেনেছেন আপনি? নিরতিশয় উৎকণ্ঠা ও ব্যাকুলতা যেন গান্ধারী দেবীর কণ্ঠস্বরে ও চোখেমুখে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।
বললাম তো, যা জানবার তাই জেনেছি।
কি জেনেছেন আপনি? কি রুচিরা আপনাকে বলেছে?
মাপ করবেন গান্ধারী দেবী, সেটা আমার অনুসন্ধানের ব্যাপারে একান্ত ব্যক্তিগত ও গোপনীয় ব্যাপার।
আপনি বলতে চান রুচি আপনাকে বলেছে যে সে সমীরকে পছন্দ করে না, বিবাহ সে করবে না?
বললাম তো গান্ধারী দেবী, তিনি রুচিরা দেবী আমাকে কি বলেছেন বা না বলেছেন। বা আমি কি বলতে চাই বা না চাই সেটা প্রকাশ করতে আপনার কাছে আমি বাধ্য তো নই-ই, ইচ্ছুকও নই।
আমি বিশ্বাস করি না কিরীটীবাবু, রুচি ঐ ধরনের কোন কথা আপনাকে বলতে পারে আর যদি সে বলে থাকেও এ কথাটা যেন সে ভুলে না যায় যে, এখনও আমি তার মাথার ওপরে বেঁচে আছি। খুশিমত তাকে আমি চলতে দেব না।
হঠাৎ কিরীটী হেসে ফেলে এবং হাসতে হাসতেই বলে, গান্ধারী দেবী, এবারে আপনাদের কাছ থেকে আমি আপাততঃ বিদায় নেব। কারণ আমার কফি বোধ হয় ঠাণ্ডা-হয়ে গেল সত্যিসত্যিই এতক্ষণে। আচ্ছা আসিনমস্কার
বলতে বলতে কিরীটী দ্বিতীয় আর কোন কথা না বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
স্তম্ভিত বিস্ময়ে শকুনি ও গান্ধারী দেবী কিরীটীর গমনপথের দিকে চেয়ে রইল।
০৮. সেতারে ভৈরো আলাপ
বাঈজী সেতারে ভৈরো আলাপ করছিল ও চাপা কণ্ঠে গুনগুন সুর ভাঁজছিল।
আর অবিনাশ চৌধুরী সেই ঘরের বিস্তৃত গালিচার ওপরে একটা জাপানী ঘাসের চটি পায়ে ইতস্তত পায়চারি করছিলেন এবং নিম্নস্বরে আপন মনে আবৃত্তি করছিলেন :
নারায়ণ! নারায়ণ বল কত বাকী
আর। শত পুত্রহারা কাঁদিছে গান্ধারী,
শত পুত্রবধূ তার! রক্ত শবে পরিকীর্ণ
কুরুক্ষেত্র ভূমি! অক্ষৌহিণী নারায়ণী
সেনা হয়েছে নিঃশেষ।
মুষ্টিবদ্ধ হাত দুটি পিছনে রেখে অবিনাশ চৌধুরী পায়চারি করছিলেন।
ভোরের প্রসন্ন আলো মুক্ত বাতায়নপথে ঘরের মধ্যে বিস্তৃত রক্তবর্ণ গালিচার উপরে এসে লুটিয়ে পড়েছে।
সহসা একসময় বাঈজীর দিকে ফিরে চেয়ে অবিনাশ চৌধুরী বলেন, মুন্নাবাঈ, এখন গান থাক! আজকে তোমার বিশ্রাম— তুমি যাও।
বারেকের জন্য মাত্র অবিনাশ চৌধুরীর দিকে চেয়ে ধীরে ধীরে মুন্নাবাঈ নিঃশব্দে সেতারটা একপাশে গালিচার ওপরে নামিয়ে রেখে উঠে দাঁড়াল।
খেয়ালী অবিনাশ চৌধুরীর বিচিত্র মতিগতির সঙ্গে সে বিশেষ পরিচিত।
এবং নিঃশব্দেই সে তার নির্দিষ্ট ঘরে যাবার জন্য দরজার দিকে পা বাড়ায়।
পাশেরই সংলগ্ন একটি নাতিপ্ৰশস্ত ঘর মুন্নাবাঈয়ের জন্য নির্দিষ্ট।
মুন্নাবাঈ তার ঘরে এসে প্রবেশ করল।
আধুনিক রুচিসম্মত ভাবে ঘরটি তার সুসজ্জিত।
মুন্নার সমস্ত অন্তরের মধ্যেই তখনও যেন ভৈরো রাগের একটা সুর-মন্থন চলেছে।
প্রত্যুষের প্রসন্ন আলোয় সমস্ত অন্তর জুড়ে তার তখন যেন ভৈরো রাগের রঙ লেগেছে। জেগেছে সুর।
মেঝেতে বিস্তৃত পুরু গালিচার একপাশে রক্ষিত নিজের তানপুরাটা টেনে নিয়ে কোলের কাছে মেঝেতে গালিচার ওপরই বসে মুন্না বাঈজী।
তানপুরার তারে মৃদুমন্দ অঙ্গুলি চালনা করতে করতে সে গুনগুনিয়ে ওঠে–
ধন ধন সুরত কৃষ্ণ মুরারে
সুলছানা গিরিধারী
সব সুন্দর লাগে
অত পিয়ারী।
নিঃশব্দ পদসঞ্চারে কখন ইতিমধ্যে একসময় যে রুচিরা বাঈজীর ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করেছিল তা সে টেরও পায়নি।