রায়বাহাদুরের হত্যাকারী সম্পর্কে নিশ্চয়ই আপনার মনে কোন সুস্পষ্ট ধারণা হয়েছে—আরও সোজা করে বলতে গেলে বলা যায়, নিশ্চয়ই আপনি কাউকে এ ব্যাপারে সন্দেহ করেছেন, তাই নয় কি?
সন্দেহ করেছি!
হ্যাঁ। একটু আগে তো সেই কথাই শকুনিবাবুর কাছে আপনি বলতে বলতে থেমে গেলেন।
আমি–
শুনুন গান্ধারী দেবী, আপনি নিজেই আপনার কথার ফাঁদে আটকে পড়েছেন। এখন আর উপায় নেই। কিন্তু তারও আগে একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞাসা করতে চাই।
কি?
আপনি নিশ্চয়ই চান যে রায়বাহাদুর—আপনার ভাইকে যে অমন নিষ্ঠুরভাবে গতকাল হত্যা করেছে, সেই নৃশংস শয়তান হত্যাকারী ধরা পড়ুক এবং তার সমুচিত শাস্তিবিধান হোক।
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই চাই।
এবং এও আপনারা সকলেই জানেন সেই নিষ্ঠুর ব্যাপারের মীমাংসাই আমি করতে চাই।
হ্যাঁ।
এও নিশ্চয়ই তাহলে স্বীকার করবেন যে, নিষ্ঠুর ঐ হত্যারহস্যের মীমাংসা করতে হলে আমাকে আপনাদের—এ বাড়ির সকলেরই সাহায্যের প্রয়োজন অল্প-বিস্তর? অন্যথায় ব্যাপারটা একটু জটিলই হবে?
কিন্তু–
তাহলে বলুন আপনি যা জানেন। অকপটে সব আমার কাছে খুলে বলুন কিছু গোপন করবেন না!
কি বলব?
কাকে আপনি এ ব্যাপারে সন্দেহ করছেন খুলে বলুন?
আবার গান্ধারী দেবী নিরুত্তর, চোখেমুখে তাঁর যেন সুস্পষ্ট একটা চিন্তা ও উদ্বেগের ছায়া ঘনিয়ে ওঠে।
বলুন—চুপ করে থাকবেন না!
ক্ষমা করবেন কিরীটীবাবু, আমি–মানে আপনি আমার কথা ঠিক বুঝতে পারেননি। শকুনিকে আমি ঠিক তা বলতে চাইছিলাম না—
বিচিত্র একটা হাসি যেন কিরীটীর ওষ্ঠপ্রান্তে মুহূর্তে জেগে উঠেই মিলিয়ে গেল। এবং কৌতুকে চোখের তারা দুটি ঝকঝক করতে লাগল।
গান্ধারী দেবী, আমি কিরীটী রায়। আমার সত্যিকারের পরিচয়টা হয়ত আপনার জানা নেই, নচেৎ বুঝতে পারতেন মানুষের মনের গোপন কথাকে টেনে বের করবার একটা শক্তি ঈশ্বর আমায় দিয়েছেন। আপনার গলার স্বরকে আপনি মূক করে রাখলেও আপনার দুটি চক্ষু, স্থিরনিবদ্ধ দুটি ওষ্ঠ অনেক কিছুই এই মুহূর্তে আমার কাছে সুস্পষ্টভাবেই ব্যক্ত করছে। আপনি আপনার গত রাত্রের জবানবন্দিতে যে বলেছিলেন—আপনি ঘুমিয়ে ছিলেন এমন সময় আপনার মেয়ে রুচিরা দেবী এসে আপনার ঘুম ভাঙিয়ে আপনাকে রায়বাহাদুরের মৃত্যুসংবাদটা দেন, কথাটা যে সম্পূর্ণ মিথ্যে তা আর কেউ না জানলেও আমি কিন্তু ঠিকই ধরেছিলাম গতকালই।
মিথ্যে! কথাটা উচ্চারণ করে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে গান্ধারী দেবী কিরীটীর চোখের দৃষ্টির সঙ্গে নিজের দৃষ্টি মেলান।
হ্যাঁ, সম্পূর্ণ মিথ্যে। কিরীটীর দুচোখের দৃষ্টিতে আবার সেই শানিত ছুরির ফলার মতই তীক্ষ্ণতা ঘনিয়ে ওঠে।
এ আপনি কি বলছেন মিঃ রায়! পুনরায় প্রশ্ন করেন গান্ধারী দেবী।
হ্যাঁ, মিথ্যে। কারণ আমি জানি সে-সময় আপনি জেগেই ছিলেন এবং শুধু তাই নয়, পাশের ঘরে—মানে আপনার মেয়ের ঘরে কিছুক্ষণ পূর্বে যে সব কথাবার্তা হয়েছিল তার প্রত্যেকটি কথাই আপনার কানে গিয়েছিল।
এসব কি বলছেন আপনি মিঃ রায়!
মিথ্যে বা কল্পিত কিছুই বলছি না নিশ্চয়ই। সেটা অবশ্যই আমার চাইতেও আপনি ভালই বুঝতে পারছেন গান্ধারী দেবী।
কিন্তু আমার মেয়ে রুচিরাও কি আপনাকে বলেনি যে সে এসে আমাকে ঘুম হতে উঠিয়ে
হ্যাঁ বলেছিলেন, তবে ঘুম তো নয় সেটা আপনার গান্ধারী দেবীবলতে পারেন ঘুমের ভান মাত্র।
চকিতে শকুনি ঘোষ একবার গান্ধারী দেবী ও একবার কিরীটীর মুখের দিকে তাকায় ঐ সময়।
কিরীটীর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিকে কিন্তু সেটুকুও ফাঁকি দিতে পারে না।
কিন্তু কিরীটীর চোখে মুখে তার কোন লক্ষণই প্রকাশ পায় না।
ঘুমের ভান! আমি ঘুমোইনি—ঘুমের ভান করে ছিলাম?
ঠিক তাই। কারণ ঐভাবে জেগে ঘুমোনোর হয়ত আপনার বহু সময়েই প্রয়োজন হয়, অবশ্য আপনার মেয়ে রুচিরা দেবীর পক্ষে সেটা না জানাই সম্ভব।
না জানাই সম্ভব!
হ্যাঁ। অন্যথায় নিশ্চয়ই রুচিরা দেবী আপনার সম্পর্কে সজাগ হয়ে থাকতেন এবং যথাবিহিত সতর্কতাও হয়ত অবলম্বন করতেন।
কিরীটীবাবু!
একটা রুক্ষ তীক্ষ্ণতা যেন গান্ধারী দেবীর কণ্ঠস্বরে ঐ মুহূর্তে প্রকাশ পায়।
গান্ধারী দেবী, কিরীটী রায়ের এই দুজোড়া চোখ ছাড়াও আর এক জোড়া চোখ—অদৃশ্যও বলতে পারেন, সদা এমন সতর্ক থাকে যে তার দৃষ্টিকে এড়িয়ে যাওয়া অনেকের পক্ষেই খুব সহজসাধ্য নয়। শুনুন তবে, গতরাত্রে আপনি যখন রায়বাহাদুরের ঘরে উঠে এসেছিলেন সে সময় আপনার চোখের পাতায় কোথাও আপনার ক্ষণপূর্বে কথিত নিদ্রার বিন্দুমাত্রও আমি দেখতে পাইনি। শুধু তাই নয়, আপনার মাথার চুল ও বেশভূষায় এমন একটা নিখুঁত পারিপাট্য ছিল যা অন্ততঃ কোন সদ্য-নিদ্রোথিত ব্যক্তির মধ্যে পাওয়া যেতে পারে না। বিশেষ করে যাঁকে একটু আগে ঘুম থেকে ডেকে তুলে একটা দুঃসংবাদ দেওয়া হয়েছে এবং যার জন্য অন্ততঃ তিনি পূবাহ্নে আদপেই প্রস্তুত ছিলেন না। আরও একটা ব্যাপার যেটা হয়ত আপনার ভাববারও প্রয়োজন হয়নি এবং আপনার নজর দেওয়ারও অবকাশ হয়নি, আপনি কাল যখন রায়বাহাদুরের ঘরে এসে প্রবেশ করেছিলেন, আপনার গায়ে একটা ফুলহাতা গরম-জামা ছিল। নিশ্চয়ই গরম-জামা গায়ে দিয়েও যেমন আপনি নিদ্রা যান না তেমনি ও ঘরে আসবার পূর্বেও অত বড় একটা দুঃসংবাদ শোনবার পর গরম-জামাটা গায়ে দিয়ে আসবার কথাটাও আপনার মনে আসবার কথা নয় এবং স্বাভাবিকও নয়।