উঠুন ডাক্তারবাবু।
আগে ডাক্তার ও পশ্চাতে বৃদ্ধ গাড়ির মধ্যে উঠে বসে অতঃপর।
গাড়ির দরজা বন্ধ করে দিয়ে রামনরেশও গাড়িতে উঠে বসে স্টার্ট দিল।
গাড়ি নিঃশব্দ গতিতে অগ্রসর হয়ে দক্ষিণ দিকে বাঁক নিয়ে মেটাল রোডের উপর পড়তেই স্পীড় নেয় প্রায় ঘণ্টায় পঞ্চাশ মাইলের কাছাকাছি।
নিস্তব্ধ মৃদু কুয়াশা ঘেরা, স্বল্প চন্দ্রালোকিত মধ্যরাত্রি।
মেটালে বাঁধানো মসৃণ উঁচু-নীচু পাহাড়ী পথ।
সুতীব্র হেড লাইটের আলো ফেলে গাড়ি ছুটছে হুঁ হুঁ করে গন্তব্যপথে।
ডাক্তার পকেট থেকে চামড়ার সিগার কেসটা বের করে একটা সিগারে অগ্নিসংযোগ করল।
জ্বলন্ত সিগারে গোটা দুই টান দিয়ে পাশে উপবিষ্ট বৃদ্ধের দিকে আড়চোখে একবার তাকিয়ে। মৃদু কণ্ঠে প্রশ্ন করল, আপনার নামটা জানতে পারি কি?
বিলক্ষণ। শ্রীকুণ্ডলেশ্বর শম। ব্রাহ্মণ, বারেন্দ্র শ্রেণী–কাশ্যপ গোত্র–
ভদ্রলোকের নামের সঙ্গে সঙ্গে গোত্রের পরিচয়টা পর্যন্ত পেয়ে ডাক্তার যে একটু বিস্মিত হয়নি তা নয়। তাই কিছুক্ষণ অতঃপর চুপ করেই থাকে। তারপর আবার প্রশ্ন করে, হুঁ, আচ্ছা কুণ্ডলেশ্বরবাবু, রায়বাহাদুরের অসুখটা কি কিছুই জানেন না আপনি?
বলছিলাম কি আজ্ঞে, জানিও বটে আবার জানি নাও বটে।
কুণ্ডলেশ্বরের কথায় ডাক্তার এবার যেন একটু বেশ কৌতূহলী হয়ে ওঠে এবং অন্তরের কৌতূহলটা চেপে রাখতে না পেরে প্রশ্ন করে, কি রকম? জানেন অথচ আবার জানেনও না!
আজ্ঞে তাই।
হুঁ, তা কতদিন রায়বাহাদুরের ওখানে কাজ করছেন?
তা বিশ বৎসর। হ্যাঁ, তা বলছিলাম কি, তাই হবে বইকি।
ওঃ, তবে তো অনেক দিন আছেন। অনেক দিনকার পুরনো লোক আপনি।
তা তো বটেই। তবে বলছিলাম কি আজ্ঞে, নিজে যখন যাচ্ছেন সবই তো আজ্ঞে স্বচক্ষে দেখবেন আর জানতেও পারবেন আজ্ঞে।
ডাঃ সেন বুঝতে পারে যে কোন কারণেই হোক কুণ্ডলেশ্বর রায়বাহাদুরের রোগের সংবাদটি তাকে দিতে ইচ্ছুক নয় আপাততঃ।
এরপর আর পীড়াপীড়ি করাটা শোভন দেখায় না, অতএব নিঃশব্দে সে ধূমপানই করতে থাকে।
.
ইউরোপ থেকে বহু কষ্টে নিজের চেষ্টায় এফ.আর.সি.এস হয়ে এসে কলকাতা শহরে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য সচেষ্ট হয় ডাঃ সমর সেন নবীন উদ্যমে ও আশায়, কিন্তু দু বছর ধৈর্য ধরে থেকেও যখন প্র্যাকটিসের ব্যাপারে বিশেষ কোন সুবিধাই করতে পারল না ডাঃ সমর সেন—এবং প্রায় উপবাসের সামিল—অর্থাৎ যে বস্তুটি হলে স্থূলভাবে এ জগতে বেঁচে থাকা চলে সেই অর্থের অনটনটা ক্রমশঃ এমন জটিল হয়ে উঠতে লাগল যে উপবাসও বটে, সেই সঙ্গে অস্তিত্বটুকুও যাবার যোগাড় তখন বিলাতী খেতাবটা পকেটস্থ করে এক প্রকার বাধ্য। হয়েই মহানগরীর মায়া ত্যাগ করেছিল সে। তারপর কিছুদিন ধরে অনেক ভেবে সে কোন এক ধনী বন্ধুর কাছ থেকে হাজার দুই টাকা ধার করে বিহারের এই খনিপ্রধান অঞ্চলে এসে ডেরা বেঁধে প্রাটি শুরু করল।
এবারে বোধ হয় ভাগ্যদেবী সুপ্রসন্ন ছিলেন। বৎসরখানেকের মধ্যেই সুচিকিৎসক হিসাবে সমর সেনের নামটা আশপাশে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল।
এবং ইতিমধ্যে চার-পাঁচ মাইলের মধ্যে যত ধনী কোল মাইনসের প্রোপাইটার সকলের সঙ্গে অল্পবিস্তর পরিচয় ঘটেছিল কিন্তু আজ পর্যন্ত রায়বাহাদুর দুযযাধন চৌধুরীর নাম তো সে শোনননি।
বিচিত্র কৌতূহলকে কেন্দ্র করে সময়ের মনের মধ্যে নানাবিধ চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল। কুণ্ডলেশ্বর শমা নিস্তব্ধ নিঝুম হয়ে তার পাশেই বসে আছে।
অন্ধকারে আর একবার চোখ ঘুরিয়ে তাকাল সমর কুণ্ডলেশ্বরের দিকে, কিন্তু দেখা গেল লোকটার মুখ। ভদ্রলোকের নামটিও অদ্ভুত। নিঃশব্দ গতিতে দামী গাড়ি মসৃণ রাস্তার উপর দিয়ে যেন হাওয়ার বেগে ছুটে চলেছে। আঁকাবাবাঁকা উচুনীচু পথ। একটানা গাড়ির ইঞ্জিনের একটা চাপা গোঁ গোঁ শব্দ ও হাওয়ার সোঁ সোঁ শব্দের সংমিশ্রণ। মধ্যরাত্রে ঘুম ভেঙে তোলায় চোখের পাতায় ঘুম যেন তখনও জড়িয়ে আছে।
এবং গাড়ির দোলায় কখন একসময় বুঝি ঘুমিয়েও পড়েছিল সমর—হঠাৎ একটা মৃদু ঝাঁকুনি ও একটা দীর্ঘ বিশ্রী চিৎকারে তন্দ্রা ছুটে গেল।
উঁ! উঁ!
কুয়াশাচ্ছন্ন সামান্য যেটুকু চন্দ্রকিরণ প্রকৃতি জুড়ে এতক্ষণ স্বপ্নের মতই বিরাজ করছিল, ইতিমধ্যে সেটুকুও যেন কখন নিভে গিয়েছে।
থমথমে অন্ধকারে বিশ্রী চিৎকারের শব্দটা যেন ভৌতিক এক বিভীষিকার মত রাত্রির অন্ধকারকে চিরে দিয়ে গেল।
সমর চমকে চোখ মেলে তাকায়। ড্রাইভার রামনরেশ ততক্ষণে গাড়ি থামিয়ে নেমে দাঁড়িয়ে হাতল ঘুরিয়ে গাড়ির দরজা খুলে দিয়েছে।
বলছিলাম কি আজ্ঞে, শ্রীনিলয়ে এসে গেছি ডাক্তারবাবু–নামুন আজ্ঞে।
কুণ্ডলেশ্বরের কথায় সমর গাড়ি থেকে নামে। পোটিকোর নীচে গাড়ি দাঁড়িয়েছে। সামনেই টানা দীর্ঘ বারান্দা লোহার রেলিং দিয়ে ঘেরা।
স্বল্প-শক্তির একটা প্রজ্বলিত বৈদ্যুতিক বাতি পোটিকোর সিলিং থেকে ঝুলছে, তারই মৃদু আলোয় বারান্দার কিয়দংশ ও সম্মুখের পোর্টিকো আলো-আঁধারিতে যেন অদ্ভুত একটা রহস্যে নিবিড় হয়ে উঠেছে।
সমর গাড়ির ভেতর থেকে তার ডাক্তারী ব্যাগটা নামাতে যেতেই কুণ্ডলেশ্বর বাধা দিল, থাক। বলছিলাম কি আজ্ঞে, কৈরালাপ্রসাদই নামিয়ে আনবেখন। চলুন।
কুণ্ডলেশ্বরের ইঙ্গিতে সমর সিঁড়ি অতিক্রম করে বারান্দা-পথে অগ্রসর হয়। আগে কুণ্ডলেশ্বর, পেছনে সমর। দীর্ঘ বারান্দা অতিক্রম করে কুণ্ডলেশ্বরকে অনুসরণ করে একসময় উভয়ে প্রকাণ্ড একটা বন্ধ দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়।