একটি শব্দও কিছুক্ষণ যেন তার কণ্ঠ হতে বের হয় না।
কিরীটী বলে, মানুষ স্বার্থের খাতিরে কখন যে কি করতে পারে আর না পারে, সে মানুষও নিজে অনেক সময় বোধ হয় চিন্তাও করতে পারে না, স্বপ্নেও ভাবতে পারে না মিঃ ঘোষ। জানেন না তো আপনি, এ পৃথিবীটাই একটা বিচিত্র জায়গা! সময় সময় তুচ্ছ—অতি তুচ্ছ প্রয়োজনের তাগিদে আজও সভ্যজগতের মানুষ যে কি ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুরতারই পরিচয় দিতে পারে আমি বহুবার স্বচক্ষে দেখেছি। যাক সে কথা। এখন আপনি যদি আমার কয়েকটি প্রশ্নের জবাব দেন তবে সুখী হব। ডাঃ সানিয়ালের ঘরে আমাকে এখুনি আবার যেতে হবে। তাঁরা আমার জন্য অপেক্ষা করছেন।
বলুন কি জানতে চান? নিস্তেজ নিম্নকণ্ঠে শকুনি ঘোষ প্রত্যুত্তর দিল।
০৭. ব্যস্ত হবেন না মিঃ ঘোঘ
ব্যস্ত হবেন না মিঃ ঘোঘ, আপনি বসুন ঐ খাটে।
শকুনি ধীরে ধীরে তার খাটের ওপর বসে। কিরীটী তখন প্রশ্ন শুরু করে।
এবারে বলুন, কাল রাত্রে ঠিক কটার সময় আপনি শুতে আসেন?
রাত তখন গোটাতিনেক হবে সে কথা তো একটু আগেই আপনাকে বললাম।
আপনি আমার মুখ থেকে আপনার মামার হত্যার সংবাদ শোনবার পূর্ব পর্যন্ত তাহলে সত্যিই। কিছুই শোনেননি বা জানতে পারেননি ঐ সম্পর্কে, এই কি সত্যি?
হ্যাঁ।
আচ্ছা আপনি বিছানায় শোয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন কাল রাত্রে?
কিরীটীর প্রশ্নে শকুনি ঘোষ প্রথমটায় কেমন যেন একটু ইতস্তত করে, তারপর মৃদুকণ্ঠে বলে, ঠিক সঙ্গে সঙ্গেই ঘুম আসেনি। তবে বেশীক্ষণ জেগে যে ছিলাম না এও ঠিক।
হুঁ। সেই সময় কেউ আপনার ঘরে আসেনি?
শকুনি আবার কিছুক্ষণ যেন চুপ করে থাকে, একটু বিব্রত ও চিন্তিত সে। কিরীটী চেয়ে আছে শকুনির মুখের দিকে।
এবং তারপর যেন কতকটা দ্বিধাগ্রস্ত ভাবেই শকুনি বলে, না।
আবার কিরীটী কথাটার যেন পুনরুক্তি করে, কেউ আসেনি ঠিক বলছেন?
তাই।
ঠিক আপনার মনে আছে?
হ্যাঁ।
বাইরে ঠিক ঐ সময় যেন একটা দ্রুত পদশব্দ শোনা গেল। কে যেন এই ঘরের দিকেই আসছে মনে হল।
কিরীটী ঘরে ঢুকেই ভেতর থেকে ঘরের কপাট দুটো ভেজিয়ে প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিল, সেই প্রায়-বন্ধ কপাটের দিকে চোখ তুলে তাকাল কিরীটী।
সহসা প্রায়-বন্ধ কপাট দুটি খুলে গেল এবং পরক্ষণেই উন্মুক্ত দ্বারপথে যে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল তার দিকে তাকিয়ে কিরীটী যেন বেশ একটু বিস্মিতই হয়।
কেবল আগন্তুককে দেখেই কিরীটী ততটা বিস্মিত হয়নি, যতটা হয়েছিল আগন্তুকের সমগ্র চোখেমুখে একটা ভীতি ও উৎকণ্ঠা মিশ্রিত চাঞ্চল্য দেখে।
আগন্তুক বোধ হয় কক্ষে প্রবেশ করেই কিরীটীকে দেখতে পায়নি, কারণ কিরীটী ঘরের একপাশে দাঁড়িয়েছিল সেই সময়।
শেকো, শুনেছিস কি সর্বনাশ হয়ে গেছে!
একরাশ উৎকণ্ঠা আগন্তুকের কণ্ঠস্বরে যেন ঝরে পড়ে।
কিরীটী নিঃশব্দ পদসঞ্চারে আরও একটু পিছিয়ে গেল।
আগন্তুক কিরীটীকে তখনও দেখতে পায়নি। বলে, তোরা কেউ বিশ্বাস করিসনি বটে তবে এ যে হবে তা কিন্তু আমি প্রথম থেকে দাদার কথা শুনেই বুঝতে পেরেছিলাম। আর এও তো জানা কথা এ কার কাজ–
আগন্তুকের বাকি কথাগুলো শেষ হল না, উপবিষ্ট নির্বাক স্থিরদৃষ্টি শকুনির দিকে চেয়ে এতক্ষণে বোধ হয় কেমন একটু মনে মনে সন্দিগ্ধ হয়ে পাশের দিকে তাকাতেই অদূরে দণ্ডায়মান নির্বাক কিরীটীর স্থির দুটি জিজ্ঞাসু দৃষ্টির সঙ্গে নিজের চোখের দৃষ্টি মিলিত হয়ে গেল।
মুহূর্তে বক্তার সমগ্র শরীরের স্নায়ু ও উপস্নায়ু দিয়ে একটা তীব্র বিদ্যুৎ-তরঙ্গ বুঝি খেলে গেল।
কথাটা যা বলছিলেন গান্ধারী দেবী, হঠাৎ বলতে বলতে থেমে গেলেন কেন? কিরীটী প্রশ্ন করে।
মৃত রায়বাহাদুরের অপরূপ সুন্দরী বিধবা ভগিনী গান্ধারী দেবীই আগন্তুক।
মুহূর্তে যেন একটা বিপর্যয় ঘটে গিয়েছে, প্রচন্ড একটা বৈদ্যুতিক শক্তি নিমেষে সমগ্র স্নায়ুতে আঘাত দিয়ে গান্ধারী দেবীর সমস্ত বাক্ ও বোধশক্তিকে যেন মুহূর্তে হরণ করেছে।
গান্ধারী দেবী যেন প্রাণহীন একটা পাথরে পরিণত হয়েছেন অকস্মাৎ।
মূক অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন গান্ধারী দেবী কিরীটীর মুখের দিকে।
বসুন গান্ধারী দেবী। আপনার যা বলবার বা শকুনিবাবুকে যা বলতে এসেছিলেন নির্ভয়ে বলুন। কোন ভয় নেই আপনার, আমি কথা দিচ্ছি আপনাকে বিশ্বাস করুন, তৃতীয় কোন ব্যক্তিই এসব কথা জানতে পারবে না।
গান্ধারী দেবী তথাপিও কিন্তু নিরুত্তর।
ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকেন গান্ধারী দেবী কিরীটীর মুখের দিকে।
বসুন গান্ধারী দেবী। ঐ চেয়ারটায় বসুন। কিরীটী পুনরায় আহ্বান জানায় গান্ধারী দেবীকে।
অত্যন্ত সহজ ভাবে কিরীটী কথাগুলো উচ্চারণ করলেও কণ্ঠস্বরে একটা সুস্পষ্ট নির্দেশের সুর যেন প্রকাশ পায়।
এ শুধুমাত্র অনুরোধই নয়, আদেশও।
এবং সে আদেশকে লঙঘন করা অনেকের পক্ষেই দুঃসাধ্য।
তথাপি কিন্তু গান্ধারী দেবী নিশ্চপ, পাষাণ-প্রতিমার মতই যেমন দাঁড়িয়ে ছিলেন তেমনি দাঁড়িয়ে রইলেন।
কিরীটী আবার বলে স্থির অপলক দৃষ্টিতে গান্ধারী দেবীর চোখের দিকে চেয়ে, বসুন গান্ধারী দেবী!
এবারে সত্যিসত্যিই গান্ধারী দেবী কতকটা মন্ত্রমুগ্ধের মতই যেন সামনের চেয়ারটার ওপর গিয়ে বসলেন
হ্যাঁ বলুন এবারে—একটু আগে যা বলতে বলতে থেমে গিয়েছিলেন!
কি বলব? ক্ষীণ কণ্ঠে এতক্ষণে গান্ধারী দেবী কথা কটি বলেন।